‘ত্রিনিদাদ না মিলওয়াকি?’
অঙ্গনা এক লহমা না ভেবেই বলল ‘ত্রিনিদাদ’!
সময়কে ডলারে (বা টাকায়) মাপতে যারা অভ্যস্ত তারা ত্রিনিদাদে এসে হকচকিয়ে যাবে। কারোর কোনো তাড়া নেই। ক্যালেন্ডারে বাঁধা নেই সময়। সমস্ত শহরটায় সব সময় গান বাজছে।
প্রাচীন ইঁটে বাঁধানো উনবিংশ শতাব্দীর গলিপথ। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে দেখব হাট করে খোলা দরজা জানলা। প্রাচীন ঝাড়বাতি আসবাবপত্রে সাজানো অন্দরমহল। বাড়ির গড়নগুলোও সুপ্রাচীন। মধ্যে মধ্যেই ঘরের ভেতর থেকে কিউবান সঙ্গীত ভেসে আসছে।
প্লাজা মানে চৌক। চার দিকে উনবিংশ শতাব্দীতে থমকে থাকা বাড়ি ঘর, রেস্তোরাঁ। মাঝখানে পার্ক। সেখানে বসলেই স্থানীয় লোকদের সাথে আড্ডা হয়ে যাবে। কেউ বা নিজে থেকেই কথা বলবে।
কেউ বা সিগার আঙুলে নিয়ে তারস্বরে গান ধরবে। কারো হাতে মোহিতো বা পিনাকোলাদা। কারো বা হাতে স্থানীয় মদ। এখানে সুরা বা ধুম্রপানের সঙ্গে কোনো সোশ্যাল স্টিগমা জুড়ে নেই। অনেকে প্রকাশ্যেই খেতে খেতে আড্ডা মারছে, গান করছে। কেউ বা আবার সঙ্গীকে স্পর্শ করে নাচছে। ভিনদেশিদের সাথে স্থানীয়রাও নেমে পড়েছে। যেন এক আনন্দ উৎসব।
ভাষার তফাতেও কিছু আটকাচ্ছে না। ওরা সপ্রতিভ ভাবে এস্পানিওলে চেষ্টা করছে বিদেশীদের সাথে মেশার। বাঙালির যতটা ইংরাজির প্রতি দাসসুলভ আনুগত্ত আছে, এখানে তার এক কণাও নেই। তাতে ভাষায় কিছু আটকালেও হৃদয়ে আটকাচ্ছে না। (অবশ্য চীনা বা জার্মান বা জাপানিরাও নিজেদের মধ্যে তাদের নিজেদের ভাষাতেই কথা বলে। এ পৃথিবীর সর্বত্র দেখেছি। একমাত্র ‘মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট ‘ বঙ্গসন্তানরা নিজেদের মধ্যে ইংরাজি চালায়।)
আমরা ছিলাম মার্থার বাড়িতে। তার একতলায় ড্রয়িংরুম। গোল করে সাজানো প্রাচীন রকিং চেয়ার। সেখানে দরজা হাট করে খোলা। সকলে আড্ডা দেয় বিকেলে। দু-তলায় আমাদের ঘর। পাশে লাগোয়া ছোট্ট ছাদ। সেখানে সাদা রঙের নকশা কাটা চেয়ার টেবিল। প্রাতরাশের ব্যবস্থা। সেই ছোট্ট ছাদ ঝুঁকেছে গৃহের অন্দরে। সেখানে উঠোন। টালি দেওয়া ছায়াবদ্ধ স্থান। চেয়ার রাখা আছে। হয়ত খোলা আকাশ মাথায় রেখে কেউ বসতে পারে।
পুঁজিবাদ মুলত মানুষকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করে। সে শেখায় যে সময় হচ্ছে ডলার। অতএব প্রতিটি ঘন্টাকে ডলারে পরিণত করা চাই। যে দেশ এটা যত এফিশিয়েন্টলি পারবে তার তত বেশি জিডিপি। গত বছর ভুটান আর এবারে কিউবা গিয়ে দেখলাম যে এসমস্ত কে ‘দুত্তোর’ বলে দিব্যি মিলেমিশে আনন্দে বাঁচা যায়। তাতে বস্তুগত প্রাচুর্য্য হয়ত কিছু কম হয়। কিন্তু মানবিক বেঁচে থাকা হয় ঢের বেশি।
তা বলে এরা কেউ অলস নয়। ভোর পৌনে ছটায় এসেছিল রবের্তো। ত্রিনিদাদের গলিতে আলাপ। রিকশা চালায়। সে আমাদেরকে ত্রিনিদাদ ঘুরে দেখাবে। ‘ভোর বেলা আসতে পারবে?’
‘সি (হ্যাঁ)’
রবের্তো আমাদের রিকশায় চাপিয়ে প্রায়ান্ধকার ভোরের ত্রিনিদাদে টহল দিতে বেরোলো। সঙ্গে এক ছোট্ট কুকুর ‘মোচো’। অনেকটা হাচিসনের বিজ্ঞাপনের মত। রিকশা যথায় যায় কুকুর যায় পিছে পিছে। মজার ব্যাপার। কাকভোরে রাস্তায় রাস্তায় কফি বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো বাড়িতে গৃহস্বামিই করছেন। নাম মাত্র দাম। রবের্তো আমাদের কফি খাওয়ালো (মাই ফার্স্ট ইন্ডিয়ান ফ্রেণ্ড)।
রবের্তোর দুই বিয়ে তিন সন্তান। ‘আই এম রেসপন্সিবল পার্সন’। হাসি মুখে রিকশা ঠেলতে ঠেলতে বলল রবের্তো।
‘কিউবায় শিক্ষা নিয়ে চিন্তা নেই। সরকার দেয়। খুবই ভালো। স্বাস্থ পরিষেবাও খুব ভালো। বাকিটার জন্য পরিশ্রম করতে হয়।’
হাভানায় ফেরার পথে ঠাহর করেছিলাম রাস্তায় তেমন প্রাইভেট গাড়ি নেই। তাহলে কি গাড়ি কিনে টহল দেওয়া যাবে না? মন একটু বিষন্ন হয়েছিল। তারপরই বিদ্যুৎ চমকের মত খেয়াল হল কোথাও শিশুশ্রমিকও তো দেখিনি! মার্কিণ এমবার্গোতে বিধ্বস্ত একটা একচিলতে দেশ যদি সব শিশুকে খাদ্য দিতে পারে তাহলে গাড়ি না থাকাটা তো নস্যি।