জেসাস কিউবার শ্রমিক। মাসে তিরিশ পেসো রোজগার করেন।
‘এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব ভালো। সরকার দেয়। শিক্ষাও সরকারী। কিন্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি ফ্রি।’
যতক্ষণ ক্যামেরা চলছিল জেসাস স্বদেশের প্রশংসায় পন্চমুখ। ক্যামেরা থামতেই সে এক অন্য গল্প বললে। চিকিৎসা আর শিক্ষা নিখরচায়, ঘরভারা হয় শুন্য নতুবা এক পেসো (‘ভেরি চিপ’)। বিদ্যুৎ, রান্নার জ্বালানি, জল ‘ভেরি চিপ’!
কিন্তু ‘ফুড ভেরি এক্সপেন্সিভ’! আমরা যে সব রেস্তোরাঁয় খাচ্ছি সাধারণ কিউবানদের সেখানে দেখিনি। অথচ দুজনে মিলে একবেলার খাবারে খরচ করতাম চারশো টাকা (ভারতীয় টাকার হিসেবে)। এটুকু অন্তত দেশের শহরে বহু ভারতীয়ই খেতে পারে। খায়।
যতগুলো রেস্তোরাঁয় খেয়েছি কোথ্থাও কিউবান চোখে পড়েনি। তবে কি সাধারণ কিউবানের জন্য এটুকুও ‘affordable’ নয়?
জেসাস বলল কিউবায় মানুষের মনে ‘ফিয়ার’ আছে। সে মনের কথা বলতে ভয় পায়। সরকার যদি ‘বদলা’ নেয় তাহলে সমস্ত পরিবারের জীবন ভেসে যাবে।
সত্যি মিথ্যা জানিনা কিন্তু খাওয়ার কষ্ট আর বাক্স্বাধীনতার অভাবের কথা আরও কিছু কিউবানের কাছে শুনেছি।
কাস্ত্রো, চে ছাড়া কারোর পোস্টার দেখিনি। কোনো পাল্টা দেওয়াল লিখন, লিফলেট চোখে পড়েনি।
অথচ রাস্তায় তেমন পুলিশও দেখিনি। সিসিটিভি আছে কিন্তু সর্বত্র নয়। দারিদ্র আছে। ভিখারি আছে। কিন্তু সংখ্যায় সামান্য।
শ্রমজীবি মানুষ সুচিকিৎসা আর সম্মানজনক শিক্ষা পাচ্ছেন। অথচ খাওয়াটা, কথা বলাটা ভয়ে ভয়ে করতে হচ্ছে এ কেমন উলটপুরাণ!
ভারতীয় হিসেবে মনটা খচখচ করে উঠল। আমরা সরকারকে এন্তার গালমন্দ করে থাকি। সরকার জেলে টেলে পুরে দেয় বটে। তবু আমরা চিৎকার করতে ছাড়ি না। লন্ডনে থাকাকালীন দুটো মিছিল দেখেছিলাম হাইড পার্কে। সরকারের মুণ্ডপাত চলছিল। আমাদের মিলওয়াকিতেও প্যালেস্তাাইনের পক্ষে, মার্কিণ সরকারের বিপক্ষে মিছিল দেখেছি। দমন সেখানেও আছে। কিন্তু শ্মশানের শান্তি নেই। মাত্র কটা দিন থেকে এর চেয়ে বেশি বলা ঠিক হবে না। তবু মনে হল ‘রাজা তোর কাপড় কোথা?’ বলাটা খুব জরুরি। আধপেটা খেয়েও মানুষ স্বাধীন স্বাভিমানি হয়ে বাঁচতে চায়।
খাওয়ার কথা উঠল যখন বলি। সাধারণ ভাবে কিউবানরা ভাত খায়। আমাদেরই মত! (মজার ব্যাপার হল হাভানা আর কলকাতা প্রায় একই অক্ষরেখায় অবস্থিত)। সাথে থাকে মাংস (গরু, শুয়োর বা মুরগী)। মাছও খায় ওরা। চিংড়ি বা লবস্টার দেখেছি। ভাতের সাথে কালো বিন্সএর ঝোল। একটু আলু সেদ্ধ দেয় (ম্যাশ্ড পোটাটো)।
খাবার যথারীতি বিস্বাদ। রন্ধনশিল্পে ভারতই প্রথম বিশ্ব (কলকাতা হয়ত তার রাজধানী)। আমেরিকা বা ইউরোপে খাদ্য সাধারণ ভাবে বিস্বাদ হয়। কিছু সস্ আর চিজ্ দিয়ে ওরা সামলানোর চেষ্টা করে বটে। কিন্তু দেশের সর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ বা কচি পাঁঠার ঝোলের তুলনায় এই চেষ্টা নিতান্ত শিশুসুলভ।
কিউবা থেকে ফিরছি। সঙ্গে চলেছে সহস্র মুহুর্ত। ত্রিনিদাদের রিক্শাচালক রবের্তো আর তার কুকুর মোচো। সবুজ জলে স্তব্ধ হয়ে থাকা ক্যারিবিয়ান সাগরের সৈকত প্লায়া আঙ্কন। সিগার শ্রমিক জেসাস। হাভানার সেই যুগল যারা আমাদের গান শুনিয়ে ছিলো। উনবিংশ শতাব্দীতে থমকে থাকা শহর ত্রিনিদাদ। প্রাণোচ্ছল প্রাচীন শহর হাভানা। আদিগন্ত বিস্তৃত আখের ক্ষেত। কাউবয়। হঠাৎ আলাপ হওয়া বাংলাদেশের মা ও মেয়ে।
ধন্য কিউবা। আমাদের মানুষ দেখার সাধ সে মিটিয়ে দিয়েছে।