কিউবার ডাইরি ৭… সমাপ্ত

জেসাস কিউবার শ্রমিক। মাসে তিরিশ পেসো রোজগার করেন।

‘এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা খুব ভালো। সরকার দেয়। শিক্ষাও সরকারী। কিন্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি ফ্রি।’

যতক্ষণ ক্যামেরা চলছিল জেসাস স্বদেশের প্রশংসায় পন্চমুখ। ক্যামেরা থামতেই সে এক অন্য গল্প বললে। চিকিৎসা আর শিক্ষা নিখরচায়, ঘরভারা হয় শুন্য নতুবা এক পেসো (‘ভেরি চিপ’)। বিদ্যুৎ, রান্নার জ্বালানি, জল ‘ভেরি চিপ’!

কিন্তু ‘ফুড ভেরি এক্সপেন্সিভ’! আমরা যে সব রেস্তোরাঁয় খাচ্ছি সাধারণ কিউবানদের সেখানে দেখিনি। অথচ দুজনে মিলে একবেলার খাবারে খরচ করতাম চারশো টাকা (ভারতীয় টাকার হিসেবে)। এটুকু অন্তত দেশের শহরে বহু ভারতীয়ই খেতে পারে। খায়।

যতগুলো রেস্তোরাঁয় খেয়েছি কোথ্থাও কিউবান চোখে পড়েনি। তবে কি সাধারণ কিউবানের জন্য এটুকুও ‘affordable’ নয়?

জেসাস বলল কিউবায় মানুষের মনে ‘ফিয়ার’ আছে। সে মনের কথা বলতে ভয় পায়। সরকার যদি ‘বদলা’ নেয় তাহলে সমস্ত পরিবারের জীবন ভেসে যাবে।

সত্যি মিথ্যা জানিনা কিন্তু খাওয়ার কষ্ট আর বাক্স্বাধীনতার অভাবের কথা আরও কিছু কিউবানের কাছে শুনেছি।

কাস্ত্রো, চে ছাড়া কারোর পোস্টার দেখিনি। কোনো পাল্টা দেওয়াল লিখন, লিফলেট চোখে পড়েনি।

অথচ রাস্তায় তেমন পুলিশও দেখিনি। সিসিটিভি আছে কিন্তু সর্বত্র নয়। দারিদ্র আছে। ভিখারি আছে। কিন্তু সংখ্যায় সামান্য।

শ্রমজীবি মানুষ সুচিকিৎসা আর সম্মানজনক শিক্ষা পাচ্ছেন। অথচ খাওয়াটা, কথা বলাটা ভয়ে ভয়ে করতে হচ্ছে এ কেমন উলটপুরাণ!

ভারতীয় হিসেবে মনটা খচখচ করে উঠল। আমরা সরকারকে এন্তার গালমন্দ করে থাকি। সরকার জেলে টেলে পুরে দেয় বটে। তবু আমরা চিৎকার করতে ছাড়ি না। লন্ডনে থাকাকালীন দুটো মিছিল দেখেছিলাম হাইড পার্কে। সরকারের মুণ্ডপাত চলছিল। আমাদের মিলওয়াকিতেও প্যালেস্তাাইনের পক্ষে, মার্কিণ সরকারের বিপক্ষে মিছিল দেখেছি। দমন সেখানেও আছে। কিন্তু শ্মশানের শান্তি নেই। মাত্র কটা দিন থেকে এর চেয়ে বেশি বলা ঠিক হবে না। তবু মনে হল ‘রাজা তোর কাপড় কোথা?’ বলাটা খুব জরুরি। আধপেটা খেয়েও মানুষ স্বাধীন স্বাভিমানি হয়ে বাঁচতে চায়।

খাওয়ার কথা উঠল যখন বলি। সাধারণ ভাবে কিউবানরা ভাত খায়। আমাদেরই মত! (মজার ব্যাপার হল হাভানা আর কলকাতা প্রায় একই অক্ষরেখায় অবস্থিত)। সাথে থাকে মাংস (গরু, শুয়োর বা মুরগী)। মাছও খায় ওরা। চিংড়ি বা লবস্টার দেখেছি। ভাতের সাথে কালো বিন্সএর ঝোল। একটু আলু সেদ্ধ দেয় (ম্যাশ্ড পোটাটো)।

খাবার যথারীতি বিস্বাদ। রন্ধনশিল্পে ভারতই প্রথম বিশ্ব (কলকাতা হয়ত তার রাজধানী)। আমেরিকা বা ইউরোপে খাদ্য সাধারণ ভাবে বিস্বাদ হয়। কিছু সস্ আর চিজ্ দিয়ে ওরা সামলানোর চেষ্টা করে বটে। কিন্তু দেশের সর্ষে বাটা দিয়ে ইলিশ বা কচি পাঁঠার ঝোলের তুলনায় এই চেষ্টা নিতান্ত শিশুসুলভ।

কিউবা থেকে ফিরছি। সঙ্গে চলেছে সহস্র মুহুর্ত। ত্রিনিদাদের রিক্শাচালক রবের্তো আর তার কুকুর মোচো। সবুজ জলে স্তব্ধ হয়ে থাকা ক্যারিবিয়ান সাগরের সৈকত প্লায়া আঙ্কন। সিগার শ্রমিক জেসাস। হাভানার সেই যুগল যারা আমাদের গান শুনিয়ে ছিলো। উনবিংশ শতাব্দীতে থমকে থাকা শহর ত্রিনিদাদ। প্রাণোচ্ছল প্রাচীন শহর হাভানা। আদিগন্ত বিস্তৃত আখের ক্ষেত। কাউবয়। হঠাৎ আলাপ হওয়া বাংলাদেশের মা ও মেয়ে।

ধন্য কিউবা। আমাদের মানুষ দেখার সাধ সে মিটিয়ে দিয়েছে।

 

কিউবার ডাইরি ৬

কেন বেড়াতে যাই?

গগনচুম্বী অট্টালিকা দেখার সাধ আমার নেই। নিউইয়র্ক থেকে লণ্ডন, চৌরঙ্গি থেকে ডালাস, সে দেখেছি ঢের। শুষ্ক দেয়াল উঠেছে আকাশ ফুঁড়ে।

প্রকৃতির সৌন্দর্য্য? আমি বাংলার রুপ দেখেছি। হিমালয় থেকে স্কটিশ পাহাড়চূড়া অবধি স্পর্শ করেছি। সত্যি বলতে শুধু মাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখার জন্য কারোর ভারতবর্ষ ছেড়ে না নড়লেও চলে।

আমি বেড়াতে যাই মানুষের সাথে মিশব বলে। নতুন দেশ মানে নতুন মানুষ। যদি কোনো নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন মানুষের সাথে আড্ডাই না হল, তা হলে সে যাওয়ার কোনো মানে নেই। ঠিক এই কারণে আমার মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে যেতে আমার বিরক্ত লাগে। প্রতিটি মানুষ নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে তাদের অন্য কারোর সাথে কথা বলার ফুরসত টুকু নেই।

আর এই খানেই কিউবার জিত।

অঙ্গনা গতকাল শাড়ি পড়েছিল। আমি পড়লাম পাঞ্জাবি। এনেছি যখন পড়ে ফেলা যাক, ভাবটা খানিক এরকম। আর তারপর যেন ম্যাজিক ঘটে গেল।

হাভানার রাস্তায় প্রায় ডজন খানেক মানুষ আমাদের সহাস্য মুখে অভিনন্দন জানালেন, ‘লা ইন্ডিয়া! কালকুতা! টেগোর! গান্ধী!’ সহসা বুঝলাম যে কিউবানরা ভারতীয় দের খুবই পছন্দ করে। তার একটা কারণ হয়ত হিন্দী ছবি। ট্রেড এমবার্গোর কারণে হলিউড এখানে তেমন দাঁত ফোঁটাতে পারেনি। তারই জায়গা নিয়েছে বলিউড। বিনোদন তো চাই। আর আছেন রবীন্দ্রনাথ।

সেন্ট্রাল প্লাজায় দেখা হয়ে গেল দুই বাঙালি পর্য্যটকের সাথে। মা ও মেয়ে বেড়াতে এসেছেন। চট্টগ্রামে আদি বাড়ি হলেও ওরা থাকেন নিউইয়র্কে। মা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। মেয়ে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সাইন্স পড়ছে।

’আমি আইন নিয়ে পড়তে চাই ভবিষ্যতে। আপাতত একটা সোশ্যাল অর্গানাইজেশনে কাজ করছি। ওরা ইমিগ্রেশন নিয়ে সাউথ এশিয়ান দের সাহায্য করে।’ মেয়েটি আমায় জানালো।

‘নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে পুলিশের উৎপাত বেড়েছে আজকাল। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের খুব ধরছে। কাগজপত্র ঠিক না থাকলেই দেশে চালান করছে। আমরা নবাগতদের তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করি। নারী স্বাধীনতার ওপর কাজও হয়।’

ভদ্রমহিলার পায়ে সর্ষে। শান্তিনিকেতন থেকে কফি হাউস, মেলবোর্ণ থেকে নেদারল্যাণ্ডস, তিনি বহু জায়গায় গেছেন। আমাদের কফি খাওয়ালেন। একদম বাঙালি আড্ডা জমে গেল বিকেলের হাভানায়।

ইতিমধ্যে পথে এক সিগার শ্রমিক জেসাসের সাথে আলাপ হল। সে ‘লা ইন্ডিয়ান’ বলে থমকে গিয়ে আমাদের সাথে আড্ডা জুড়েছে। তার থেকে কিউবার সম্বন্ধে বেশ কিছু কথা জানতে পারলাম। কতক গুলো আগেই শুনেছিলাম। রবের্তো বা মারিওর কাছে, ত্রিনিদাদে। কতকটা নতুন।

বিকেলে দেখা হলো সারিমার সাথে। অর্জুনদার (আমার শ্যালক) বন্ধু। লন্ডনে পড়ার সময় ওদের বন্ধুত্ত্ব হয়েছিল।

সারিমা ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাতে চায়, ‘আমি ছোটো থেকেই হাভানায় আছি। এখানে মানুষজন খুব রিল্যাক্সড থাকে। তুমি যদি খুব ব্যস্ত হও, তাহলে সম্ভবত তোমার হাভানাতে খুব একটা বন্ধু হবে না।’ ও হাসতে হাসতে বলল। আমরা বসেছিলাম সান লাজারাস আর ইনফ্যান্টার মোড়ে, একটা ক্যাফেতে।

মানুষ মানুষ! জ্যান্ত মানুষ সর্বত্র। তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কথা বলছে। গান গাইছে। কেউ বা কফি খাওয়াচ্ছে, ফল উপহার দিচ্ছে। হেমিংওয়ের পধধূলিধন্য কাফে লা বোদেগিতার দেওয়ালে তাই বাঙলায় লিখে এসেছি এক লাইন। এত প্রাণ যে শহরে সে তো আমারই কলকাতা।

কিউবার ইতিহাস ৬

কিউবা এক অদ্ভুত দেশ। তার ভূমিপুত্র তাইনোরা কচুকাটা হল এস্পানিওলদের হাতে। তারপর সেই এস্পানিওলরাই হয়ে উঠল এখানকার প্রধান বাসিন্দা। তাদের ক্ষেতে, কারখানায় খাটতে এল আফ্রিকার থেকে ক্রীতদাস। তারাও হয়ে উঠল এখানকার মানুষ। হিস্পানিওলায় ক্রীতদাস বিদ্রোহে তাড়া খেয়ে পৌঁছল ত্রিশ হাজার ফরাসি জমিদার। তারাও কিউবার বুকে খুঁজে নিলো নিজের দেশ। এক চিলতে দেশ। তাতে কত বৈচিত্র। মানুষের, সংস্কৃতির, স্থাপত্যের, আদব কায়দার।

কিউবা কিন্তু তখনও পরাধীন। রাজদণ্ড স্পেনের হাতে বাঁধা। প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বিফল হল নির্মম ভাবে ১৮৭৮এ। কিন্তু সেই সংগ্রামের একটা দাবী আদায় করা গেল ১৮৮০তেই। দাসপ্রথা উঠে গেল কিউবার মাটি থেকে। এটুকু থেকেই অনুমান করা সম্ভব যে কি বিপুল প্রভাব ফেলেছিল প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ।

ষোল বছরের হোসে মার্তি ১৮৬৮তে জেল বন্দী হয়েছিলেন। কসুর ছিল বিদ্রোহের কবিতা লেখা। পরবর্তী কালে যুবক হোসে মার্তি বিদ্রোহের আগুন বুকে নিয়ে কিউবা থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় পাড়ি দিলেন। লিখতে থাকলেন অসংখ্য প্রবন্ধ, কবিতা। তার অক্ষর ধরে কিউবার দ্বিতীয় বিদ্রোহের সলতে পাকানো চলতে থাকল। এদিক থেকে হোসে মার্তি একাধারে রাসবিহারি বসু এবং অরবিন্দ ঘোষের সমতুল্য। রাসবিহারি বসুর মত তিনি সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছেন স্বাধীনতার জন্য। অরবিন্দ ঘোষের মত তিনি লিখেছেন অজস্র লেখা এবং সেই লেখার হাত ধরে বহু যুবক বিপ্লবের স্বপ্ন গেঁথেছে। আমাদের দেশে যেমন যুগান্তর বা অনুশীলন সমীতি গড়ে উঠেছিল, ইতালিতে যেমন ছিল কারবোনারি, তেমনি হোসে মার্তি গড়ে তুললেন পিআরসি (পার্তিদো রেভ্যুলিশনারিও ক্যুবানো)। কিউবা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী সংগঠন।

হোসে মার্তির ডাকে সাড়া দিলেন প্রথম বিপ্লবের দুই কাণ্ডারি, ম্যাসিও আর গোমেজ। ১৮৯৫ সালে মার্তির অনুগামিরা হাভানায় অভ্যুত্থান শুরু করলে। এস্পানিওলরা যখন সেই বিদ্রোহ সামাল দিতে ব্যস্ত, সেই ফাঁকে মার্তি তার দলবল নিয়ে মেক্সিকো থেকে পৌঁছলেন কিউবার বারাকোয়ায়। দেশে পৌঁছেই মার্তি সেনাবাহিনী গড়ে তুললেন। প্রায় চল্লিশ হাজার বিদ্রোহীকে নিয়ে যুদ্ধ ঘোষনা করলেন স্পেন রাজদণ্ডের বিরুদ্ধে। প্রথম সম্মুখ সমরেই হোসে মার্তির মৃত্যু হয়। উনিশে মে দস রিওসের অনামা যুদ্ধক্ষেত্রে মার্তির মৃত্যুর সাথে শেষ হয়ে গেল এক আমৃত্যু সংগ্রামী কবির জীবন। আজও কিউবার প্রতিটি শহরে মার্তির স্মৃতি জাগরুক হয়ে আছে।

মার্তি মরলেন বটে। রেখে গেলেন তার অনুগামি দের। তারা লড়াই চালাতে থাকল। এস্পানিওলরা নির্মম ভাবে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করলে। হাজার হাজার কিউবানকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী করা হল যাতে তারা বিদ্রোহীদের সাহায্য না করতে পারেন। ১৮৯৬ সালে ম্যাসিও যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হলেন। হঠাৎ যেন স্বাধীনতা সংগ্রামের হাওয়া রাজার পক্ষে ঘুরে যেতে লাগল।

এই রকম এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করল মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র।

কিউবা তখন আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়িক বন্ধু। বহু আমেরিকান ব্যবসা সূত্রে কিউবায় থাকেন। বিদ্রোহের গন্ধ পেয়ে আমেরিকান সরকার তার যুদ্ধ জাহাজ মেইন (Maine) কে পাঠিয়ে দিলো হাভানায়। উদ্দেশ্য বিদ্রোহের আগুন থেকে মার্কিন নাগরিকদের রক্ষা করা। ১৮৯৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। হাভানা উপকুলে মেইন জাহাজ এক বিপুল বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গেল। মৃত্যু হল ২৬৬ জন আমেরিকান নাবিকের। আমেরিকা ভাবল যে স্পেন বুঝি তার জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে। সে স্পেনকে কিউবা কিনে নেওয়ার জন্য শেষবার একটা আবেদন পাঠালো। এবার দর তিনশো মিলিয়ান ডলার। স্পেন এবারও পত্রপাঠ নাকচ করে দিলে। আমেরিকার এই তৃতীয় চেষ্টা কিউবা কিনে নেওয়ার। এবারে সে আর অপেক্ষা করতে রাজি হলো না।

পয়লা জুলাই সান হুয়ান পাহাড়ে থিয়োডর রুসভেল্টের নেতৃত্ত্বে মার্কিণ বাহিনী কিউবা আক্রমণ করল। সতেরোই জুলাই-এর মধ্যে এই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। এস্পানিওলরা সম্পূর্ণ ভাবে পরাস্ত হয়।

আমেরিকানরা অবশ্য কিউবা সরাসরী দখলে রাখেনি। তারা একটা আধা স্বাধীনতার বন্দোবস্ত করলে। অভ্যন্তরীণ কাজে কর্মে কিউবা স্বাধীনতা পেলো। ১৯০০ সালে কিউবার আমেরিকান গভর্নর জেনারেল লিওনার্ড উড দরবার ডাকলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমেরিকার সংবিধানের মত করে কিউবার সংবিধান রচনা করলেন। আমেরিকান আর্মি এপ্রোপ্রিয়েশন বিলে এটুকু বলা রইল যে আমেরিকা যখনই মনে করবে কিউবার সামরিক কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করতে পারবে।

এ অনেকটা ব্রিটিশ আর দেশিয় রাজাদের মধ্যে ব্যবস্থার মত। স্বাধীনতা আছে। অথচ নেই!

এই গোটা শান্তি চুক্তিতে আমেরিকান আর এস্পানিওলদের কেউই বিদ্রোহীদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। অতএব কিছুটা প্রশমিত হলেও স্বাধীনতার হার না মানা আকুতি কিউবার হৃদয়ে জ্বলতেই থাকল।

 

কিউবার ইতিহাস ৫

১৮৬৮ সাল। রবি ঠাকুর মোটে পদ্ম দাসীর গুনগুনানি শুনছেন। ভারতে সিপাহি বিদ্রোহের পর এক দশক কেটে গেছে। সেই সময়ের কিউবার গল্প বলছি।

স্পেনের অধীন কিউবায় প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হল।

কিউবা আর ভারত। দুই দেশই স্বাধীনতার জন্য লড়ছে তখন। অথচ তাদের অবস্থার মধ্যে কত তফাৎ!

কিউবার নিজস্ব মানুষ তাইনোরা ততদিনে নিশ্চিহ্ণ। চার লক্ষ দাসের শ্রম কিউবাতে এক প্রকার অর্থনৈতিক স্বর্ণ যুগ এনে ফেলেছে (অবশ্যই প্রভুদের স্বর্ণযুগ)। কিউবার মানুষ বলতে তখন এস্পানিওল, ফরাসি, আফ্রিকান, ব্রিটিশদের এক সাড়ে বত্রিশভাজা।

১৮৬৮ সালে বিদ্রোহ করলে ক্রিওলো জমিদারবর্গ। (ক্রিওলো অর্থাৎ যে এস্পানিওল উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকায় জন্মেছেন)।

কার্লোস সেসপেদেস চিনি কলের মালিক ছিলেন। পেশায় আইনজ্ঞ, নেশায় কবি এই ক্রিওলো জমিদার তার ডেমাজাগুয়ার চিনি কল থেকে বিদ্রোহ ঘোষনা করলেন। আব্রাহাম লিঙ্কনের দাসপ্রথা বিরোধী ঢেউ তখন কিউবাতেও আছড়ে পড়ছে। কার্লোস নিজের সমস্ত দাসদের মুক্তি দিলেন। প্রায় পনেরোশো রিসালার এক মুক্তি ফৌজ গঠন করে এস্পানিওল প্রভুদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে দিলেন।

এক দিকে এস্পানিওল রাজতন্ত্র আর পেনিনসুলারেস (যে এস্পানিওলরা স্পেনে জন্মেছেন)। বিপ্রতিপে ক্রিওলো জোতদার, চিনিকল মালিকদের জোট। কার্লোসের ডাকে কিউবা দ্বীপে এক মহারণ শুরু হয়ে গেল। স্বাধীনতার পক্ষে যোগ দিলেন ‘ব্রোঞ্জ টাইটান’ নামে খ্যাত জেনারেল আন্তোনিও ম্যাসিও। সঙ্গে এলেন আরেক যোদ্ধা ডমিনিকান ম্যাক্সিমো গোমেজ।

প্রায় দশ বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল। দু লক্ষ কিউবান এবং ৮০০০০ এস্পানিওল এই লড়াইএ প্রাণ দেয়। ১৮৭৮ সালে শেষমেশ বিদ্রোহীদের সাথে স্পেনের রাজতন্ত্রের শান্তি চুক্তি হল। স্বাধীনতা এলো না। বিফল মনোরথ হয়ে গা ঢাকা দিলেন দুই বিদ্রোহী, গোমেজ আরে মাসিও। কার্লোস সেসপেদেস অবশ্য ১৮৭৪এই মারা গেছেন যুদ্ধে।

কিউবার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তি এনে দিলো না ঠিকই। কিন্তু সে ছিল সলতে পাকানোর পর্ব।

১৮৬৮ সালের কথা। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঠিক শুরুর মুখে এক ষোল বছরের কিশোর কবিতা লিখলেন। বিদ্রোহের কবিতা। স্পেন সরকার সঙ্গে সঙ্গে তাকে জেলে পুরে দিলো। এই কিশোর পরবর্তীকালে হোসে মার্তি হবেন। এবং লেখায়, তরবারীতে কিউবার পরবর্তী দেড়শো বছরের ইতিহাসকে আচ্ছন্ন করে রাখবেন।

কার্লোস সেসপেদেস কবি ছিলেন। যুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য। হোসে মার্তিও কবি। দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনিও রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হবেন। আর তার বই বুকে করে কারাগারে দিন গুনবেন আর এক আইনজ্ঞঃ ফিদেল কাস্ত্রো। সে আরো একশো বছর পরের কথা। (হাভানার মিউজিয়ামে দেখেছি হোসে মার্তির বই-এর মার্জিনে কাস্ত্রোর নোট লেখা)।

কিউবা এমন এক দেশ যেখানে অসি এবং মসি একই হস্তে ঝনঝনিয়ে উঠেছে বারবার।

 

কিউবার ডাইরি ৫

‘ত্রিনিদাদ না মিলওয়াকি?’

অঙ্গনা এক লহমা না ভেবেই বলল ‘ত্রিনিদাদ’!

সময়কে ডলারে (বা টাকায়) মাপতে যারা অভ্যস্ত তারা ত্রিনিদাদে এসে হকচকিয়ে যাবে। কারোর কোনো তাড়া নেই। ক্যালেন্ডারে বাঁধা নেই সময়। সমস্ত শহরটায় সব সময় গান বাজছে।

প্রাচীন ইঁটে বাঁধানো উনবিংশ শতাব্দীর গলিপথ। সেখানে হাঁটতে হাঁটতে দেখব হাট করে খোলা দরজা জানলা। প্রাচীন ঝাড়বাতি আসবাবপত্রে সাজানো অন্দরমহল। বাড়ির গড়নগুলোও সুপ্রাচীন। মধ্যে মধ্যেই ঘরের ভেতর থেকে কিউবান সঙ্গীত ভেসে আসছে।

প্লাজা মানে চৌক। চার দিকে উনবিংশ শতাব্দীতে থমকে থাকা বাড়ি ঘর, রেস্তোরাঁ। মাঝখানে পার্ক। সেখানে বসলেই স্থানীয় লোকদের সাথে আড্ডা হয়ে যাবে। কেউ বা নিজে থেকেই কথা বলবে।

কেউ বা সিগার আঙুলে নিয়ে তারস্বরে গান ধরবে। কারো হাতে মোহিতো বা পিনাকোলাদা। কারো বা হাতে স্থানীয় মদ। এখানে সুরা বা ধুম্রপানের সঙ্গে কোনো সোশ্যাল স্টিগমা জুড়ে নেই। অনেকে প্রকাশ্যেই খেতে খেতে আড্ডা মারছে, গান করছে। কেউ বা আবার সঙ্গীকে স্পর্শ করে নাচছে। ভিনদেশিদের সাথে স্থানীয়রাও নেমে পড়েছে। যেন এক আনন্দ উৎসব।

ভাষার তফাতেও কিছু আটকাচ্ছে না। ওরা সপ্রতিভ ভাবে এস্পানিওলে চেষ্টা করছে বিদেশীদের সাথে মেশার। বাঙালির যতটা ইংরাজির প্রতি দাসসুলভ আনুগত্ত আছে, এখানে তার এক কণাও নেই। তাতে ভাষায় কিছু আটকালেও হৃদয়ে আটকাচ্ছে না। (অবশ্য চীনা বা জার্মান বা জাপানিরাও নিজেদের মধ্যে তাদের নিজেদের ভাষাতেই কথা বলে। এ পৃথিবীর সর্বত্র দেখেছি। একমাত্র ‘মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সার্ভেন্ট ‘ বঙ্গসন্তানরা নিজেদের মধ্যে ইংরাজি চালায়।)

আমরা ছিলাম মার্থার বাড়িতে। তার একতলায় ড্রয়িংরুম। গোল করে সাজানো প্রাচীন রকিং চেয়ার। সেখানে দরজা হাট করে খোলা। সকলে আড্ডা দেয় বিকেলে। দু-তলায় আমাদের ঘর। পাশে লাগোয়া ছোট্ট ছাদ। সেখানে সাদা রঙের নকশা কাটা চেয়ার টেবিল। প্রাতরাশের ব্যবস্থা। সেই ছোট্ট ছাদ ঝুঁকেছে গৃহের অন্দরে। সেখানে উঠোন। টালি দেওয়া ছায়াবদ্ধ স্থান। চেয়ার রাখা আছে। হয়ত খোলা আকাশ মাথায় রেখে কেউ বসতে পারে।

পুঁজিবাদ মুলত মানুষকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করে। সে শেখায় যে সময় হচ্ছে ডলার। অতএব প্রতিটি ঘন্টাকে ডলারে পরিণত করা চাই। যে দেশ এটা যত এফিশিয়েন্টলি পারবে তার তত বেশি জিডিপি। গত বছর ভুটান আর এবারে কিউবা গিয়ে দেখলাম যে এসমস্ত কে ‘দুত্তোর’ বলে দিব্যি মিলেমিশে আনন্দে বাঁচা যায়। তাতে বস্তুগত প্রাচুর্য্য হয়ত কিছু কম হয়। কিন্তু মানবিক বেঁচে থাকা হয় ঢের বেশি।

তা বলে এরা কেউ অলস নয়। ভোর পৌনে ছটায় এসেছিল রবের্তো। ত্রিনিদাদের গলিতে আলাপ। রিকশা চালায়। সে আমাদেরকে ত্রিনিদাদ ঘুরে দেখাবে। ‘ভোর বেলা আসতে পারবে?’

‘সি (হ্যাঁ)’

রবের্তো আমাদের রিকশায় চাপিয়ে প্রায়ান্ধকার ভোরের ত্রিনিদাদে টহল দিতে বেরোলো। সঙ্গে এক ছোট্ট কুকুর ‘মোচো’। অনেকটা হাচিসনের বিজ্ঞাপনের মত। রিকশা যথায় যায় কুকুর যায় পিছে পিছে। মজার ব্যাপার। কাকভোরে রাস্তায় রাস্তায় কফি বিক্রি হচ্ছে। কোনো কোনো বাড়িতে গৃহস্বামিই করছেন। নাম মাত্র দাম। রবের্তো আমাদের কফি খাওয়ালো (মাই ফার্স্ট ইন্ডিয়ান ফ্রেণ্ড)।

রবের্তোর দুই বিয়ে তিন সন্তান। ‘আই এম রেসপন্সিবল পার্সন’। হাসি মুখে রিকশা ঠেলতে ঠেলতে বলল রবের্তো।

‘কিউবায় শিক্ষা নিয়ে চিন্তা নেই। সরকার দেয়। খুবই ভালো। স্বাস্থ পরিষেবাও খুব ভালো। বাকিটার জন্য পরিশ্রম করতে হয়।’

হাভানায় ফেরার পথে ঠাহর করেছিলাম রাস্তায় তেমন প্রাইভেট গাড়ি নেই। তাহলে কি গাড়ি কিনে টহল দেওয়া যাবে না? মন একটু বিষন্ন হয়েছিল। তারপরই বিদ্যুৎ চমকের মত খেয়াল হল কোথাও শিশুশ্রমিকও তো দেখিনি! মার্কিণ এমবার্গোতে বিধ্বস্ত একটা একচিলতে দেশ যদি সব শিশুকে খাদ্য দিতে পারে তাহলে গাড়ি না থাকাটা তো নস্যি।

 

কিউবার ইতিহাস ৪

মানুষ আবহমান কাল ধরে ভেসে চলেছে। কখনো সে দেশান্তরে গেছে কৌতুহল বা ব্যবসার টানে। যেমন কলম্বাস ছুটে গেছিলেন নতুন মহাদেশে অথবা অধুনা আমেরিকানরা ছুটে বেড়াচ্ছেন বিশ্বময়।

আবার কখনো সে দেশান্তরি হয়েছে দাস খত লিখে। যেমন আফ্রিকানরা কিউবা পৌঁছেছিল সেকালে বা মধ্যবিত্ত ভারতীয়রা গ্রীনকার্ড লোলুপ হয়ে দৌড়য় একালে।

১৫২২ সালে সেই প্রথম আফ্রিকার থেকে দাস পৌঁছল কিউবায়। তাদের শ্রমের জোরে পরবর্তী একশো বছরে কিউবা এক বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ালো। যা ছিল এক আদিবাসী অধ্যুষিত গণ্ডগ্রাম, তা হল চিনির কল, তামাকের ক্ষেত, আর পশুপালনের সুবিশাল বাণিজ্য কেন্দ্র।

এস্পানিওল ব্যবসাদারদের এই বাড়বাড়ন্ত দেখে ছুটে এলো কালান্তক জলি রজার!

জলি রজার… জলি রজার… মাথার খুলি আঁকা কৃষ্ণকায় পতাকা। জলদস্যুদের প্রতিক। এই দস্যুরা লুঠ করতে শুরু করল কিউবার বন্দর। সান্তিয়াগো দে ক্যুবা লুঠ হল ১৫৫৪তে। হাভানা তার এক বছর পরে।

দস্যুদের রোখার জন্য এস্পানিওলরা এক ঝাঁক কেল্লা নির্মাণ করল বন্দর এলাকায়। কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। ১৬৬০ সালে জামাইকার দস্যু গভর্নর হেনরি মর্গান বারংবার কিউবা লুঠ করছিলেন।

এস্পানিওলদের এই রাজ্যপাট চলেছিল প্রায় চারশ বছর। ‘প্রায়’ কারণ মাঝখানে ১ বছর সে ব্রিটিশদের অধীন ছিল। ১৭৬২ সালে স্পেন আর ফ্রান্স হাত মেলালো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। স্পেনকে শায়েস্তা করার জন্য প্রায় বিশ হাজার ব্রিটিশ সৈনিক কিউবা আক্রমণ করলে। ৬ই জুন তারা কঞ্জিমারের ছোট্ট একটা গ্রামে অবতরণ করে প্রবাদপ্রতীম কেল্লা এল মরো দখল করে নিলে। দু মাস ধরে লড়াই চালানোর পর এস্পানিওলরা বাধ্য হয়েই হাভানাকে ব্রিটিশ হস্তে সমর্পণ করল।

ব্রিটিশরা চিরকাল ব্যবসায় চৌখস। তারা কিউবা দখল করে ব্যবসার নিয়মকানুন সরল করে দিলো। এতে চিনির ব্যবসায় একটা জোয়ার এলো।

১৭৯০ সালে হাইতিতে দাস বিদ্রোহের পর প্রায় ত্রিশ হাজার ফরাসি জমিদার কিউবাতে পালিয়ে এসেছিল। তারা চিনি এবং কফি উৎপাদনের নব্য পদ্ধতি গুলো বেশ জানত। তারা দ্রুত শিখে নিলো কিউবার জল হাওয়ার ঢঙ। ফরাসিদের হাত ধরেই কিউবায় কফি এস্টেট (ক্যাফেটেলস) গুলোর পত্তন হয়। গেইলিক সভ্যতার ছাপ কিউবার গানে, খানায়, আসবাবে, স্বভাবে একটা গভীর ছাপ রেখে গেছে।

এই ভাবে কিউবার বুকে একে একে এস্পানিওল, আফ্রিকান, ব্রিটিশ, ফরাসিদের এক সাড়ে বত্রিশ ভাজা আস্তানা গেড়েছিল। ব্রিটিশরা অবশ্য কিউবার দখল স্পেনকে ফিরিয়ে দেয় ১৭৬৩ সালেই। বিনিময়ে তারা স্পেনের থেকে নিয়েছিল ফ্লোরিডা।

১৮২০ সাল নাগাদ কিউবা ছিল দুনিয়ার বৃহত্তম চিনি উৎপাদক। আর তার সবচে বড় ক্রেতা সদ্য স্বাধীন হওয়া মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র। কিউবা থেকে এত চিনি আমদানি করছিল আমেরিকা যে একসময় আমেরিকার সরকার কিউবাকে কিনে নেওয়া কথা ভাবল। সেই মর্মে টমাস জেফারসন (চতুর্থ মার্কিণ প্রেসিডেন্ট) স্পেনের কাছে দরপত্র পাঠান ১৮০৮ সালে। ১৮৪৫ সালে প্রেসিডেন্ট পোল্ক, ১০০ মিলিয়ান ডলার দর দেন। দুবারই স্পেন প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।

১৮৪০ সাল নাগাদ কিউবাতে প্রায় চার লক্ষ দাস ছিল। তাদের বেশিরভাগই পশ্চিম আফ্রিকার। তাদের শ্রমে কিউবার অর্থনীতিতে এক (বড়লোকদের) স্বর্ণযুগ এসেছিল। যখন সাইমন বলিভারের নেতৃত্ত্বে ১৮২০ সাল নাগাদ গোটা লাতিন আমেরিকায় স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে তখন কিউবা তার এস্পানিওল প্রভুদের প্রতি বিশ্বস্তই থেকে গেছে।

স্বাধীনতার লড়াই কিউবার বুকে আছড়ে পড়েছিল আরও চল্লিশ বছর পর।

কিউবার ডাইরি ৪

রাস্তার মোড়ে সন্ধ্যে হলেই দোকান পাট বন্ধ। সাইকেল রিকশা ঘুরছে। উঁচু দরজার বাড়ি। তার সামনে বসে কজন বেশ গল্প করছে। প্রাসাদোপম মুরিশ-বারোক স্থাপত্য। তাতে কখোনোবা নিও-ক্লাসিক্যাল স্পর্শ। কিছু পরে পরেই বাড়িগুলোর ভেতর থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে।

এই হল হাভানা।

এমনি হাভানার প্রেমে পড়ব তা আর বিচিত্র কি।

দুরাত কাটিয়ে পাবলো আর ওলগা কে বিদায় জানালাম। ওরাই ট্যাক্সি বুক করে দিয়েছিল। চার ঘন্টার যাত্রা। হাভানা থেকে ত্রিনিদাদ। আমার একটি মাত্র স্প্যানিশ শব্দ পুঁজিঃ গ্রাসিয়াস!

ত্রিনিদাদের পথে আমাদের সঙ্গী হলেন এক অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি। আমাদেরই মতন, এক বর্ণ স্প্যানিশ জানেন না। অথচ মেক্সিকো চষে এসেছেন এর আগে। আর পরবর্তী পাঁচ সপ্তাহ দক্ষিণ আমেরিকায় কাটাবেন!

‘এখানে ইন্টারনেট না থাকায় খুবই অসুবিধা। ট্রিপটা প্ল্যান করতে পারছি না।’

আমি খানিক হেসে বললাম, ‘গুগুল ট্রিপস আর অফলাইন ম্যাপ – এ দুটো ডাউনলোড করে নিয়েছ?’

এ দুটো এপ্লিকেশন একদম মোক্ষম। অফলাইন ম্যাপস থাকলে যাতায়াতে কোনো সমস্যা থাকে না। ইন্টারনেট ছাড়াও দিব্যি চলে। আর গুগুল ট্রিপসে যাবতীয় দর্শনীয় স্থানের তথ্য থাকে। সেও অফলাইন! যে কোনো অভিযাত্রির এই দুটো অবশ্যই সঙ্গে রাখা উচিৎ। আর অবশ্যই গুগুল ট্রান্সলেট।

কিউবায় দুটো মুদ্রা চলে! কুপ (CUP) আর কুক (CUC)। কুকটা পর্য্যটকদের জন্য। এক ডলার সমান প্রায় এক কুক! ট্যুরিস্ট এলাকায় বেশিরভাগ দোকানই কুক নিতে চায়। কিন্তু একটু মাথা খাটালে বেশ সস্তায় খাওয়া-দাওয়া সম্ভব।

একদিন নেপচুনো মোড়ের এক কাফেতে বসে বার্গার খাচ্ছি। এমনি সময় এক স্প্যানিশ ছোকড়া বুদ্ধিটা বাতলালে, ‘দু রকম কারেন্সিই রাখুন। ১ কুকে ২৪ কুপ অথবা পেসো ক্যুবানো! লোকাল দোকানে সস্তায় পেসো ব্যবহার করে খাবার দাবার পাবেন। আর বড় দোকানে বা ক্রুসে গেলে কুক ব্যবহার করুন।’

তাই করেছি হাভানায়।

হাভানায় পুরোনো মডেলের হুডখোলা আমেরিকান গাড়ির খুব চল। তাই ভাড়া করলাম ঘন্টা খানেকের হাভানা পরিক্রমায়। তারা কুপ কিছুতেই নেবে না। তাই কুকে কাজ সারতে হল। তারপরে রাতে খেলাম এক ছোট্ট ‘অনাদি কেবিন’ গোছের দোকানে। সেখানে আবার কুপ দিব্যি চলে গেল।

কিউবার ইতিহাস ২

কলম্বাস প্রথম কিউবা এসেছিলেন ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে। তারও প্রায় বিশ বছর পর শুরু হল কিউবা দখলের প্রথম অভিযান। এস্পানিওল কাপিতান দিয়েগো ভেলাজকেজের নেতৃত্ত্বে, চারটি রণতরী ধেয়ে এলো হিস্পানিওলা থেকে। মোটে চারশো জন রিসালা নিয়ে ভেলাজকেজ কিউবা দখল করলেন। আদিবাসী তাইনো-রা তাদের কুটিরে মুখ লুকালো।

ভেলাজকেজ সত্যিকারের বীর ছিলেন। তিনি আদিবাসীদের ওপর অত্যাচারকে কঠোর হাতে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু রক্তলোলুপ এস্পানিওল যোদ্ধাদের কেই বা সামলাতে পারে। তারা আদিবাসীদের প্রতি নৃশংস অত্যাচার করতে শুরু করল। তাইনো আদিবাসীরা প্রথম হকচকিয়ে গয়ে পালাতে চেষ্টা করল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইল। ‘হাতুয়ে’ ছিলেন সেরকম একজন তাইনো মোড়ল। সাহসী, বীর, এবং একরোখা। হাতুয়ের নেতৃত্ত্বে কিউবায় প্রথম আদিবাসী বিদ্রোহ হয়।

এস্পানিওলরা এই বিদ্রোহকে নৃশংস ভাবে দমন করল। হাতুয়েকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হল। আদিবাসীদের নিয়োজিত করা হল খনিতে খামারে।

পোপ ততদিনে দাসপ্রথাকে নিষিদ্ধ করেছেন। অতএব এস্পানিওলরা এক বিচিত্র পন্থা অবলম্বন করলে। ‘এনকমিয়েন্দা’। খ্রীষ্টধর্ম শেখানোর নাম করে হাজার হাজার আদিবাসীকে সোনার খনিতে কাজে লাগানো হল। ‘আদিবাসীদের দূত’ বার্তোলোমিও দে লা কাসাস ১৫৫০ সালে স্পেনের রাজার কাছে দরবার করলেন এই দুঃসহ প্রথার বিরুদ্ধে। ততদিনে অবশ্য অনেক দেরি হয়ে গেছে।

‘এনকমিয়েন্দা’ ব্যাবস্থা যখন শেষ হয় তখন মাত্র পাঁচ হাজার তাইনো আদিবাসী বেঁচে। ততদিনে ক্ষেতে, খামারে, খনিতে কাজ করার জন্য আফ্রিকা থেকে দাস আমদানী শুরু হয়ে গেছে।

কিউবার ডাইরি ৩

রকিং চেয়ারে দুলে দুলে টিভি দেখছেন ওলগা। মুরিশ স্থাপত্যের কথা বইতেই পড়েছি। মস্ত সিলিং, আর্চ করা ব্যালকনির দরজা, মিনে করা মেঝে! যেন উত্তর কলকাতার কোনো বনেদি বাড়িতে এসে পড়েছি অকস্মাত।

ওলগা আমাদের গৃহস্বামীর মা। এক বিন্দু ইংরাজি বোঝেন না। অতএব আমরা ইংরাজি আর তিনি এস্পানিওলে দিব্যি হুড়মুর করে কথা বলে গেলাম।

গৃহস্বামী পাবলোর শরীরে স্পষ্টতই এস্পানিওল রক্ত বইছে। মধ্যবয়সী পুরুষ। বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা চেহারা। ভাঙাভাঙা ইংলিশে সান নিকোলাস সরণির এক বনেদি বাড়িতে তিনি আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন।

বাড়ির থেকে কিছুটা দূরেই ক্যারাবিয়ান সাগর। সুবিশাল অতলান্তিকের ঢেউ হাভানার তীরে আছড়ে পড়ছে। আমি আর অঙ্গনা অভিভূত হয়ে পড়লাম। শহরটা যেন ষাটের দশকের এক মায়াচ্ছন্ন স্প্যানিশ রুপকথা। প্রাচীন হুডখোলা আমেরিকান গাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে উপকুল ধরে। মানুষ হো হো করে হাসছে, ছেলেমেয়েরা গলি জুড়ে খেলা করছে, গীটার হাতে কিশোর কিশোরি রোজগারের ফিকিরে গান ধরেছে। অঙ্গনাও তাদের সাথে গলা মেলালো। ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী।’ হাভানার মালেকনে আমরা রবিঠাকুরের সুর ভাসিয়ে দিলাম। সাথে শক্তির পদ্যও খানিক রইল।

সমুদ্রতটে যে বিশালকায় বাড়িগুলো, তাদের গায়ে কোনো বিজ্ঞাপন নেই। এ যেন এক অদ্ভুত স্বাধীনতা। বৃহদাকার কর্পোরেশনদের খেলার পুতুল ছিলাম এতদিন। হঠাৎ করে তাদের ক্রমাগত ‘কিনিয়ে’ দেওয়ার চক্কোর যেন মুক্তি পেয়ে গেছি।

ইন্টারনেট, ওয়াইফাই খুঁজতে গেলেই বিপদে পড়তে হবে। কিউবা সরকার শহরের কয়েক জায়গায় ওয়াইফাই হটস্পট করে রেখেছেন। ইন্টারনেট কার্ড কিনে তবে পাওয়া যাবে ওয়াইফাই। সেই বিশেষ বিশেষ এলাকায়। এ ব্যাপারটা ভালো না খারাপ তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে মানুষজনকে দেখে হঠাৎ অস্বস্তী হয়। তারা ফোনের স্ক্রীনে ডুবে নেই। একে অপরের চোখে চোখ রেখে কথা বলছে।

হাভানায় আসা অবধি একটা উত্তর কলকাতার গন্ধ আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। রসভঙ্গ হল জলের খোঁজ করতে গিয়ে। ঘর হোক বা রেস্তোরা, সর্বত্র জল কিনে খেতে হবে। ফ্রুটজুস দিচ্ছেন গৃহস্বামী (প্রাতরাশের সাথে)। জল? নৈব নৈব চ। সম্ভবত সমুদ্রে ঘেরা কিউবাতে জল মহার্ঘ্য। তাই এই ব্যবস্থা।

কিউবার ইতিহাস ১

সাদা ঘোড়ার পিঠে কালো জোব্বা পড়ে দাঁড়ালেন হোসে মার্তি। কিউবা এমন এক দেশ যেখানে কবিদের তরবারি নিয়ে যুদ্ধে যেতে হয়েছে বারবার।

উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার ঠিক মাঝামাঝি, ক্যারাবিয়ান সাগরে কিউবার অবস্থান। ছোট্ট দেশ। অথচ কি বিচিত্র তার ইতিহাস। কিউবার মাপের অন্য কোনো দেশ হয়ত পৃথিবীর ইতিহাসে এত খানি জায়গা করে নিতে পারেনি।

কার্বন ডেটিংএর মাধ্যমে জানা যায় যে কিউবার প্রথম মানুষ, গুয়ানাহাতাবে-রা, এসেছিল ৪০০০ বছর আগে। এরা প্রস্তর যুগের মানুষ। গুয়ানাহাতাবে-রা গুহায় থাকত। শিকার করাই এদের প্রধান পেশা ছিল। ২০০০ বছর পর এদের জায়গা দখল করল সিবোনে-রা। এরাও প্রাকসেরামিক যুগের মানুষ। সিবোনে-রা মাছ ধরতে আর চাষবাস করতে জানত।

প্রায় ১১০০ খ্রিষ্ঠাব্দ নাগাদ, দক্ষিণ আমেরিকার ওরিনোকো নদীর ব-দ্বীপ থেকে কিউবায় পৌঁছয় তাইনো মানব গোষ্ঠী।

তাইনোরা সিবোনে বা গুয়ানাহাতাবে-দের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত ছিল। তারা উন্নত মানের কৃষিকাজ জানত। কাপড় বুনতে এবং নৌকা বানাতে পারত। তাইনো-রা চ্যাপ্টা কপাল-কে সৌন্দর্য্যের প্রতিক হিসেবে মনে করত। শৈশবেই তারা মাথার খুলিকে এক বিশেষ প্রক্রিয়াতে চ্যাপ্টা করার চেষ্টা করত। তাদের সমাজব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাবে জটিল ছিল। প্রশাসনে গোষ্ঠীর সকলে যোগ দিতেন। অনেকটা পঞ্চায়েতের মত ব্যাবস্থা ছিল। মোড়লরা (caciques) বাকি সকলের মতামত নিয়ে কাজ চালাতেন।

কিউবায় প্রচলিত কৃষিপণ্যের ৬০ ভাগই তাইনোদের হাত ধরে শুরু হয়েছে। তামাক-কে মানুষের উপভোগ্য করে তুলেছিল এই তাইনোরাই। এখনো কিছু তাইনো শব্দ কিউবায় মুখে মুখে ফেরে। যেমন ‘গুয়াজিরো’ (আমাদের লোক)।

তাইনো গোষ্ঠী প্রায় ৪০০ বছর ধরে কিউবাতে সুখে শান্তিতে ছিল। সবই ভালো চলছিল। ১৪৯২ সালের সাতাশে অক্টোবর সকালে কিছু তাইনো যুবক যুবতী সবিস্ময়ে দেখলে যে দিকচক্রবালে এক নতুন ধরণের নৌকা ভেসে উঠেছে। সেই মস্ত জাহাজে জনৈক এস্পানিওল অভিযাত্রি দেখলেন ‘মানুষের চোখে দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ দেশ!’ হ্যাঁ, কিউবার প্রথম দর্শনে এমনটাই বলে উঠেছিলেন কলম্বাস। সাধ করে দ্বীপের নাম রেখেছিলেন ‘জুয়ানা’। এক এস্পানিওল রানির নামে নামকরণ।

কিছুদিনের মধ্যেই কলম্বাসের মোহভঙ্গ হয়। ‘দ্য গ্রেট খান’-এর সোনার দেশ (ভারতবর্ষ?) এ নয়। নিবিড় অরণ্যে ঘেরা কিউবাকে ত্যাগ করে কলম্বাস জাহাজ ভাসালেন হিসপানিওলার (হাইতি, ডমিকিকান রিপাবলিক) দিকে। আদিবাসী তাইনোদের থেকে কিউবা ছিনিয়ে নিতে কোনকিস্তাদর এস্পানিওলরা এসেছিল আরো বিশ বছর পরে।

(কিউবার ইতিহাস ১)