কিউবার ইতিহাস ৪

মানুষ আবহমান কাল ধরে ভেসে চলেছে। কখনো সে দেশান্তরে গেছে কৌতুহল বা ব্যবসার টানে। যেমন কলম্বাস ছুটে গেছিলেন নতুন মহাদেশে অথবা অধুনা আমেরিকানরা ছুটে বেড়াচ্ছেন বিশ্বময়।

আবার কখনো সে দেশান্তরি হয়েছে দাস খত লিখে। যেমন আফ্রিকানরা কিউবা পৌঁছেছিল সেকালে বা মধ্যবিত্ত ভারতীয়রা গ্রীনকার্ড লোলুপ হয়ে দৌড়য় একালে।

১৫২২ সালে সেই প্রথম আফ্রিকার থেকে দাস পৌঁছল কিউবায়। তাদের শ্রমের জোরে পরবর্তী একশো বছরে কিউবা এক বিশাল অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ালো। যা ছিল এক আদিবাসী অধ্যুষিত গণ্ডগ্রাম, তা হল চিনির কল, তামাকের ক্ষেত, আর পশুপালনের সুবিশাল বাণিজ্য কেন্দ্র।

এস্পানিওল ব্যবসাদারদের এই বাড়বাড়ন্ত দেখে ছুটে এলো কালান্তক জলি রজার!

জলি রজার… জলি রজার… মাথার খুলি আঁকা কৃষ্ণকায় পতাকা। জলদস্যুদের প্রতিক। এই দস্যুরা লুঠ করতে শুরু করল কিউবার বন্দর। সান্তিয়াগো দে ক্যুবা লুঠ হল ১৫৫৪তে। হাভানা তার এক বছর পরে।

দস্যুদের রোখার জন্য এস্পানিওলরা এক ঝাঁক কেল্লা নির্মাণ করল বন্দর এলাকায়। কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। ১৬৬০ সালে জামাইকার দস্যু গভর্নর হেনরি মর্গান বারংবার কিউবা লুঠ করছিলেন।

এস্পানিওলদের এই রাজ্যপাট চলেছিল প্রায় চারশ বছর। ‘প্রায়’ কারণ মাঝখানে ১ বছর সে ব্রিটিশদের অধীন ছিল। ১৭৬২ সালে স্পেন আর ফ্রান্স হাত মেলালো ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। স্পেনকে শায়েস্তা করার জন্য প্রায় বিশ হাজার ব্রিটিশ সৈনিক কিউবা আক্রমণ করলে। ৬ই জুন তারা কঞ্জিমারের ছোট্ট একটা গ্রামে অবতরণ করে প্রবাদপ্রতীম কেল্লা এল মরো দখল করে নিলে। দু মাস ধরে লড়াই চালানোর পর এস্পানিওলরা বাধ্য হয়েই হাভানাকে ব্রিটিশ হস্তে সমর্পণ করল।

ব্রিটিশরা চিরকাল ব্যবসায় চৌখস। তারা কিউবা দখল করে ব্যবসার নিয়মকানুন সরল করে দিলো। এতে চিনির ব্যবসায় একটা জোয়ার এলো।

১৭৯০ সালে হাইতিতে দাস বিদ্রোহের পর প্রায় ত্রিশ হাজার ফরাসি জমিদার কিউবাতে পালিয়ে এসেছিল। তারা চিনি এবং কফি উৎপাদনের নব্য পদ্ধতি গুলো বেশ জানত। তারা দ্রুত শিখে নিলো কিউবার জল হাওয়ার ঢঙ। ফরাসিদের হাত ধরেই কিউবায় কফি এস্টেট (ক্যাফেটেলস) গুলোর পত্তন হয়। গেইলিক সভ্যতার ছাপ কিউবার গানে, খানায়, আসবাবে, স্বভাবে একটা গভীর ছাপ রেখে গেছে।

এই ভাবে কিউবার বুকে একে একে এস্পানিওল, আফ্রিকান, ব্রিটিশ, ফরাসিদের এক সাড়ে বত্রিশ ভাজা আস্তানা গেড়েছিল। ব্রিটিশরা অবশ্য কিউবার দখল স্পেনকে ফিরিয়ে দেয় ১৭৬৩ সালেই। বিনিময়ে তারা স্পেনের থেকে নিয়েছিল ফ্লোরিডা।

১৮২০ সাল নাগাদ কিউবা ছিল দুনিয়ার বৃহত্তম চিনি উৎপাদক। আর তার সবচে বড় ক্রেতা সদ্য স্বাধীন হওয়া মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র। কিউবা থেকে এত চিনি আমদানি করছিল আমেরিকা যে একসময় আমেরিকার সরকার কিউবাকে কিনে নেওয়া কথা ভাবল। সেই মর্মে টমাস জেফারসন (চতুর্থ মার্কিণ প্রেসিডেন্ট) স্পেনের কাছে দরপত্র পাঠান ১৮০৮ সালে। ১৮৪৫ সালে প্রেসিডেন্ট পোল্ক, ১০০ মিলিয়ান ডলার দর দেন। দুবারই স্পেন প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।

১৮৪০ সাল নাগাদ কিউবাতে প্রায় চার লক্ষ দাস ছিল। তাদের বেশিরভাগই পশ্চিম আফ্রিকার। তাদের শ্রমে কিউবার অর্থনীতিতে এক (বড়লোকদের) স্বর্ণযুগ এসেছিল। যখন সাইমন বলিভারের নেতৃত্ত্বে ১৮২০ সাল নাগাদ গোটা লাতিন আমেরিকায় স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে তখন কিউবা তার এস্পানিওল প্রভুদের প্রতি বিশ্বস্তই থেকে গেছে।

স্বাধীনতার লড়াই কিউবার বুকে আছড়ে পড়েছিল আরও চল্লিশ বছর পর।

Leave a Comment

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.