এই অরণ্যে

বহুকাল অরণ্যে থাকি //

তবু অরণ্যের অভ্যাস হলো না।//


কলেজ স্ট্রিট ফাঁকা। আজ রোববার। মরীয়া হয়ে ভাবলাম আজ একটা বই কিনব। মন পরিষ্কার রাখব। ক্রুর হয়ে বিচার করব না ভালো মন্দ। সংস্কার মুক্ত হয়ে খুঁজব একটা ভালো বই। তারপর পাতা উলটে উলটে পড়ব। কফি হাউসে বসে।

Continue reading “এই অরণ্যে”

ফকিরদা

ফকিরদা রিটায়ার করেছেন। জানতাম না। কফি হাউসে দেখি না অনেক দিন। আজ আরেক জন কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করলাম। লোকটা নাকি আমতার দিকে থাকে। বহু বছর কফি হাউসে কাজ করেছেন। সম্ভবত মান্না দে-র সময়েও। রিটায়ার করার দিনে কোনো উৎসব হয়েছিলো কি না জানি না।

হাউসে ঢুকলেই আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকতেন। কানায় কানায় পূর্ণ কফি হাউসে ঠিক কোনো না কোনো টেবিলে বসিয়ে দিতেন। তার পর কোনো প্রশ্ন না করেই কোল্ড কফি নিয়ে চলে আসতেন।এটুকু আত্মীয়তা আমিও তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতাম। বিয়েতে আসতে বলেছিলাম। আসেননি।

এরকম কত মানুষ হারিয়ে যায়। বীণা মাসি, সন্ধ্যা পিসীর মত যারা বাড়িতে কাজ করতেন, তারা কালের নিয়মে উধাও হয়ে গেছেন। সেই ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলার মাঠে যাদের সাথে গলায় গলায় মিত্রতা হলো, তাদের মুখগুলোও আজ মনের আয়নায় অস্পষ্ট।

সুরভিত

সুরভিত কোন জন? অস্থিরই সত্য। ওই যে ঝাঁকড়া চুলো মেয়ে, সেই যে নীরব পুরুষ, সেই যে নারী-পুরুষের গণ্ডি ভাঙতে চাওয়া মানুষ। সবার মধ্যে অস্থিরতার নদী তির তির করে বইছে। আমার মধ্যেও।

Continue reading “সুরভিত”

উত্তর তিরিশ

বুদ্ধদেব বসু ‘উত্তর তিরিশ’ লিখেছেন। আমি তেমন কিছু লিখতে পারিনি। ৩৪ বছর বয়েস হয়ে গেছে। কিছু একটা লেখা উচিৎ ছিলো। এই সেদিন শিয়ালদা থেকে লক্ষিকান্তপুর লোকাল ধরে ঢাকুরিয়া যেতাম। ভোর ভোর টিউশনি। ছাত্রী সিক্স না সেভেনে পড়ত। ঘুম চোখে কাকভোরে দরজা খুলে দিতো। তারপর সারাদিন কিই বা করতাম। অঙ্কই বোধহয়। নয়ত হাবিজাবি পত্র পত্রিকা পড়তাম। ফেভারিট কেবিনে। সল্টলেক, ফুলবাগান, গড়িয়া টিউশনি করে বেড়াতাম। এই সেদিন।

Continue reading “উত্তর তিরিশ”

সোমনাথ লাহিড়ী

১৯ তারিখ সোমনাথ লাহিড়ীর মৃত্যুদিন। আমাদের বাড়ি জোড়াসাঁকো। সেখানে মস্ত বস্তি। উচ্ছেদ করার জন্য বহুকাল আগে পেয়াদা এসেছিলো। সোমনাথ লাহিড়ী নাকি সটান রাস্তায় শুয়ে পড়ে রুখে দিয়েছিলেন। উচ্ছেদ আর হয়নি।

অনেক গুলো প্রজন্মের কিছু গরিব গুর্বো মানুষ তাই দেশের বড় একটা শহরের ঠিক মধ্যিখানে ঠাঁই পেয়ে গেছে। হ্যাঁ, জবরদখল। এর বদলে একটা বড় মল হতে পারত। ফিটফাট রাস্তা হতে পারত। সেসব হয় নি। শুধু বেশ কিছু মেহনতি মানুষ এক টুকরো প্রাইম রিয়েল এস্টেট আঁকড়ে জীবন যুদ্ধে টিঁকে গেছে।

এরকম লড়াই-এর একটা দুনিয়া আছে। ক্ষুধার সূচকে ভারত যখন পারিস্তান-বাংলাদেশেরও নীচে, জি এন সাইবাবা থেকে উমর খালিদরা যখন নিজের দেশে বন্দী, তখন চোখ বুজে হাম দো হমারে দো করাই যায়। কিন্তু তাতে সুখি হওয়া যায় কি? চারপাশে তো দেখি না। বরং দেখি ‘আমি’ ‘আমি’ করতে করতে পালে পালে মানুষ আরো আরো খারাপ থেকে চলেছে।

ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্সের জন্য তাই কলকাতাকে ভালোবাসি। দিনের প্রথম অংশে যেমন গবেষণা করতে পারি, মধ্য অংশে তেমনি ব্যবসা করতে পারি। আর অপরাহ্ন পার হয়ে গেলে চোখ খুলে চলার অনুশীলনও শুরু করা যায়। মিছিলে পা মেলানো যায়। বন্ধুদের সাথে গলায় গলা মেলানো যায়। ক্ষুদ্রতা ধুয়ে মুছে সাফ হয়। এই বোধহয় ওয়ার্ক-লাইফের সঠিক ব্যালেন্স। এ নিয়ে গাদাগুচ্ছের লেখা দেখি। বিদ্রোহের কথাটা শুনি না। তাই ভাবলাম এটুকু বলা দরকার। চোখ বুজে থাকলে অসুখ কিন্তু তীব্রই হয়ে চলে।

গাড়ি চড়ব না

গাড়ি আর চড়ব না। কম চড়ব। অবশ্য আজ গরম কম। তাই এসব ভাবছি। গিরীশ পার্ক মোড়ের কাছে শশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘কত করে?’ প্রথমে উত্তর না দিয়ে ছুলতে শুরু করে দিলে। আবার শুধালাম, ‘কত করে দাদা শশা?’

আট টাকা।

Continue reading “গাড়ি চড়ব না”

অপরাজিত

তেমন করে খাটি না। তেমন করে অঙ্ক করি না। ততটা প্রাণ ঢেলে ব্যবসা করি না। অতীতে অথবা বর্তমানে, সর্বস্ব দিয়ে, তেমন কিছুই করিনি। ‘অপরাজিত’ দেখতে দেখতে অজান্তেই চোখে জল আসছিল। সবটুকু ঢেলে দেওয়া হয়ত এ জন্মে আর হলো না। যেমনটা সত্যজিত দিয়েছিলেন। অনীক দত্ত-র ছবি মোটেই বাঙালির সত্যজিৎ-মোহকে সুরসুরি দেওয়া নয়। অন্তত আমার তা মনে হয়নি। বরং সে আদিম এক অনুভূতির তারে টান দিয়েছে। সেই ক্লাস সিক্সে বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রে পড়েছিলাম – কর্মই মানুষের ধর্ম। কথাটা শুনতে সাধারণ। অথচ বেশ মনে আছে, বঙ্কিমের অনুনকরণীয় আর্গুমেন্টে, কৈশোরেই বিমোহিত হয়েছিলাম। সেই স্মৃতি আজ ফিরে এলো। অনীক দত্ত যেন আরেকটি কৃষ্ণচরিত্র নির্মাণ করেছেন। সেখানে এক অস্থির যুবক, তার ঘন ঘন মাথা নাড়ার দিনে, ঈশ্বরের পরোয়া না করে, ভয়ের লেশমাত্র না রেখে, নিজের ভালোবাসার কাজে নিজের সবটুকু উজার করে দিচ্ছে। সেই যুবক অপরাজিত রায়, আর তার সেই ধর্ম-অনুশীলন এই ছায়াছবির মূল চরিত্র।

কাব্যে, উপন্যাসে, চলচ্চিত্রে অথবা গবেষণাপত্রে কখনো সখনো মানুষের আদিম কোনো কোনো সুর ধরা পড়ে যায়। যাবতীয় ব্যাকরণের উর্দ্ধে উঠে, সেই সুর আমাদের অন্তরে টান দেয়। যে কোনো সৃষ্টির এই হলো অগ্নিপরীক্ষা। ‘অপরাজিত’ ছায়াছবি-টি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বলেই মনে হয়। সে শ্রম-এর অকুন্ঠ উদযাপন করেছে। সে নির্ভয় হতে বলেছে।

এই যে আপনি – আমি এই মুহুর্তে গড়িয়া থেকে গোলপার্ক ছুটছি। ভালোবাসার কাজে নিজের সবটুকু না উজাড় করে, অন্য অন্য কিছু করছি। নিবিড় অনুসন্ধান না করেই অনেক কথা বলছি। অনুশীলন না করেই ছবি তোলা, গান গাওয়া, পড়াশোনা করার ভান করছি। কায়দা করে কার্যোদ্ধার করছি। ‘অপরাজিত’ ছবি এ সমস্ত কিছুকে চ্যালেঞ্জ করে। সে বলে ফস ফস করে দুপাতা না লিখে সেকেন্ড ড্রাফট করো, দুমদাম সিনেমা – রিল না বানিয়ে অনুশীলন করো, পড়াশোনার ভান বা চাকরির উমেদারিতে কালক্ষয় না করে নিজের সবটা উজাড় করে অধ্যয়নে ঝাঁপ দাও। সে বলে – নিজের জন্যে সত্য শ্রম করো। যাকে ভালোবাসছ, তাকে শ্রমের অর্ঘ্য দাও। এটুকু তো আমাদের সকলের করার কথা।

ছায়াছবির প্রথম দৃশ্যে কালো চশমা চোখে বিনোদবিহারীর পদচারণা আমরা একবারই দেখি। বিশ্বভারতীতে সত্যজিৎ রায়ের আঁকার মাস্টারমশাই ছিলেন বিনোদবিহারী। পরবর্তীকালে তাকে নিয়ে সত্যজিৎ তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। শেষ দৃশ্যে, ফোন-কলে মার্টিন স্করসেসি আসেন। সেদিনের যুবক স্করসেসি আজ বিশ্ববিশ্রুত পরিচালক। পড়েছিলাম যে সত্যজিতের ‘অভিযান’ দেখে মুগ্ধ স্করসেসি পরবর্তীকালে রবার্ট ডি নিরো অভিনিত ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছবিটি বানিয়েছিলেন। পথের পাঁচালির মূল ফিল্মটি ৯০-এর দশকে লন্ডনের ল্যাবরটরিতে পুড়ে যায়। প্রায় বিশ বছর পর স্করসেসি এবং ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের তত্ত্বাবধানে সে ফিল্ম পুনরুদ্ধার হয়। অনীক দত্ত-র ছবিতে এসমস্ত গল্পের ইঙ্গিত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দত্তমশাই-এর কাজের এই কুইজ কুইজ ভাবটা আমার বরাবর ভালো লাগে। অভিনয়, দৃশ্যনির্মাণ, চিত্রনাট্য – এসব নিয়ে তো প্রশিক্ষিত চিত্রসমালোচকরা কথা বলবেন। আমি শুধু ভেবেছি একটাই কথা। এ ছবি এক আদিম সুরে টান দিয়েছে। তাই সে অপরাজিত। সত্যিই সার্থকনামা।

তেমন

যদি সব ভুল হয়ে যায়,

কষ্টে থাকি,

যদি না হতে পারি,

যেমনটা চাও।

ব্যালকনিতে যখন নামে

হু হু বাতাস,

জানি না ঠিক..

হচ্ছিনা আর কোথাও উধাও।

আমি ঠিক তেমনি থাকি,

যেমন থাকা,

কার্নিশে জলের ফোঁটা,

দেখার মত,

শুধু মুধু কষ্টে থাকি এখন তখন,

যদি সব ভুল হয়ে যায়,

সময় যত।