তেমন করে খাটি না। তেমন করে অঙ্ক করি না। ততটা প্রাণ ঢেলে ব্যবসা করি না। অতীতে অথবা বর্তমানে, সর্বস্ব দিয়ে, তেমন কিছুই করিনি। ‘অপরাজিত’ দেখতে দেখতে অজান্তেই চোখে জল আসছিল। সবটুকু ঢেলে দেওয়া হয়ত এ জন্মে আর হলো না। যেমনটা সত্যজিত দিয়েছিলেন। অনীক দত্ত-র ছবি মোটেই বাঙালির সত্যজিৎ-মোহকে সুরসুরি দেওয়া নয়। অন্তত আমার তা মনে হয়নি। বরং সে আদিম এক অনুভূতির তারে টান দিয়েছে। সেই ক্লাস সিক্সে বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রে পড়েছিলাম – কর্মই মানুষের ধর্ম। কথাটা শুনতে সাধারণ। অথচ বেশ মনে আছে, বঙ্কিমের অনুনকরণীয় আর্গুমেন্টে, কৈশোরেই বিমোহিত হয়েছিলাম। সেই স্মৃতি আজ ফিরে এলো। অনীক দত্ত যেন আরেকটি কৃষ্ণচরিত্র নির্মাণ করেছেন। সেখানে এক অস্থির যুবক, তার ঘন ঘন মাথা নাড়ার দিনে, ঈশ্বরের পরোয়া না করে, ভয়ের লেশমাত্র না রেখে, নিজের ভালোবাসার কাজে নিজের সবটুকু উজার করে দিচ্ছে। সেই যুবক অপরাজিত রায়, আর তার সেই ধর্ম-অনুশীলন এই ছায়াছবির মূল চরিত্র।
কাব্যে, উপন্যাসে, চলচ্চিত্রে অথবা গবেষণাপত্রে কখনো সখনো মানুষের আদিম কোনো কোনো সুর ধরা পড়ে যায়। যাবতীয় ব্যাকরণের উর্দ্ধে উঠে, সেই সুর আমাদের অন্তরে টান দেয়। যে কোনো সৃষ্টির এই হলো অগ্নিপরীক্ষা। ‘অপরাজিত’ ছায়াছবি-টি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে বলেই মনে হয়। সে শ্রম-এর অকুন্ঠ উদযাপন করেছে। সে নির্ভয় হতে বলেছে।
এই যে আপনি – আমি এই মুহুর্তে গড়িয়া থেকে গোলপার্ক ছুটছি। ভালোবাসার কাজে নিজের সবটুকু না উজাড় করে, অন্য অন্য কিছু করছি। নিবিড় অনুসন্ধান না করেই অনেক কথা বলছি। অনুশীলন না করেই ছবি তোলা, গান গাওয়া, পড়াশোনা করার ভান করছি। কায়দা করে কার্যোদ্ধার করছি। ‘অপরাজিত’ ছবি এ সমস্ত কিছুকে চ্যালেঞ্জ করে। সে বলে ফস ফস করে দুপাতা না লিখে সেকেন্ড ড্রাফট করো, দুমদাম সিনেমা – রিল না বানিয়ে অনুশীলন করো, পড়াশোনার ভান বা চাকরির উমেদারিতে কালক্ষয় না করে নিজের সবটা উজাড় করে অধ্যয়নে ঝাঁপ দাও। সে বলে – নিজের জন্যে সত্য শ্রম করো। যাকে ভালোবাসছ, তাকে শ্রমের অর্ঘ্য দাও। এটুকু তো আমাদের সকলের করার কথা।
ছায়াছবির প্রথম দৃশ্যে কালো চশমা চোখে বিনোদবিহারীর পদচারণা আমরা একবারই দেখি। বিশ্বভারতীতে সত্যজিৎ রায়ের আঁকার মাস্টারমশাই ছিলেন বিনোদবিহারী। পরবর্তীকালে তাকে নিয়ে সত্যজিৎ তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। শেষ দৃশ্যে, ফোন-কলে মার্টিন স্করসেসি আসেন। সেদিনের যুবক স্করসেসি আজ বিশ্ববিশ্রুত পরিচালক। পড়েছিলাম যে সত্যজিতের ‘অভিযান’ দেখে মুগ্ধ স্করসেসি পরবর্তীকালে রবার্ট ডি নিরো অভিনিত ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ছবিটি বানিয়েছিলেন। পথের পাঁচালির মূল ফিল্মটি ৯০-এর দশকে লন্ডনের ল্যাবরটরিতে পুড়ে যায়। প্রায় বিশ বছর পর স্করসেসি এবং ক্রাইটেরিয়ন কালেকশনের তত্ত্বাবধানে সে ফিল্ম পুনরুদ্ধার হয়। অনীক দত্ত-র ছবিতে এসমস্ত গল্পের ইঙ্গিত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দত্তমশাই-এর কাজের এই কুইজ কুইজ ভাবটা আমার বরাবর ভালো লাগে। অভিনয়, দৃশ্যনির্মাণ, চিত্রনাট্য – এসব নিয়ে তো প্রশিক্ষিত চিত্রসমালোচকরা কথা বলবেন। আমি শুধু ভেবেছি একটাই কথা। এ ছবি এক আদিম সুরে টান দিয়েছে। তাই সে অপরাজিত। সত্যিই সার্থকনামা।