১৮৬৮ সাল। রবি ঠাকুর মোটে পদ্ম দাসীর গুনগুনানি শুনছেন। ভারতে সিপাহি বিদ্রোহের পর এক দশক কেটে গেছে। সেই সময়ের কিউবার গল্প বলছি।
স্পেনের অধীন কিউবায় প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হল।
কিউবা আর ভারত। দুই দেশই স্বাধীনতার জন্য লড়ছে তখন। অথচ তাদের অবস্থার মধ্যে কত তফাৎ!
কিউবার নিজস্ব মানুষ তাইনোরা ততদিনে নিশ্চিহ্ণ। চার লক্ষ দাসের শ্রম কিউবাতে এক প্রকার অর্থনৈতিক স্বর্ণ যুগ এনে ফেলেছে (অবশ্যই প্রভুদের স্বর্ণযুগ)। কিউবার মানুষ বলতে তখন এস্পানিওল, ফরাসি, আফ্রিকান, ব্রিটিশদের এক সাড়ে বত্রিশভাজা।
১৮৬৮ সালে বিদ্রোহ করলে ক্রিওলো জমিদারবর্গ। (ক্রিওলো অর্থাৎ যে এস্পানিওল উত্তর বা দক্ষিণ আমেরিকায় জন্মেছেন)।
কার্লোস সেসপেদেস চিনি কলের মালিক ছিলেন। পেশায় আইনজ্ঞ, নেশায় কবি এই ক্রিওলো জমিদার তার ডেমাজাগুয়ার চিনি কল থেকে বিদ্রোহ ঘোষনা করলেন। আব্রাহাম লিঙ্কনের দাসপ্রথা বিরোধী ঢেউ তখন কিউবাতেও আছড়ে পড়ছে। কার্লোস নিজের সমস্ত দাসদের মুক্তি দিলেন। প্রায় পনেরোশো রিসালার এক মুক্তি ফৌজ গঠন করে এস্পানিওল প্রভুদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে দিলেন।
এক দিকে এস্পানিওল রাজতন্ত্র আর পেনিনসুলারেস (যে এস্পানিওলরা স্পেনে জন্মেছেন)। বিপ্রতিপে ক্রিওলো জোতদার, চিনিকল মালিকদের জোট। কার্লোসের ডাকে কিউবা দ্বীপে এক মহারণ শুরু হয়ে গেল। স্বাধীনতার পক্ষে যোগ দিলেন ‘ব্রোঞ্জ টাইটান’ নামে খ্যাত জেনারেল আন্তোনিও ম্যাসিও। সঙ্গে এলেন আরেক যোদ্ধা ডমিনিকান ম্যাক্সিমো গোমেজ।
প্রায় দশ বছর ধরে যুদ্ধ চলেছিল। দু লক্ষ কিউবান এবং ৮০০০০ এস্পানিওল এই লড়াইএ প্রাণ দেয়। ১৮৭৮ সালে শেষমেশ বিদ্রোহীদের সাথে স্পেনের রাজতন্ত্রের শান্তি চুক্তি হল। স্বাধীনতা এলো না। বিফল মনোরথ হয়ে গা ঢাকা দিলেন দুই বিদ্রোহী, গোমেজ আরে মাসিও। কার্লোস সেসপেদেস অবশ্য ১৮৭৪এই মারা গেছেন যুদ্ধে।
কিউবার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তি এনে দিলো না ঠিকই। কিন্তু সে ছিল সলতে পাকানোর পর্ব।
১৮৬৮ সালের কথা। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঠিক শুরুর মুখে এক ষোল বছরের কিশোর কবিতা লিখলেন। বিদ্রোহের কবিতা। স্পেন সরকার সঙ্গে সঙ্গে তাকে জেলে পুরে দিলো। এই কিশোর পরবর্তীকালে হোসে মার্তি হবেন। এবং লেখায়, তরবারীতে কিউবার পরবর্তী দেড়শো বছরের ইতিহাসকে আচ্ছন্ন করে রাখবেন।
কার্লোস সেসপেদেস কবি ছিলেন। যুদ্ধ করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য। হোসে মার্তিও কবি। দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনিও রণাঙ্গনে অবতীর্ণ হবেন। আর তার বই বুকে করে কারাগারে দিন গুনবেন আর এক আইনজ্ঞঃ ফিদেল কাস্ত্রো। সে আরো একশো বছর পরের কথা। (হাভানার মিউজিয়ামে দেখেছি হোসে মার্তির বই-এর মার্জিনে কাস্ত্রোর নোট লেখা)।
কিউবা এমন এক দেশ যেখানে অসি এবং মসি একই হস্তে ঝনঝনিয়ে উঠেছে বারবার।