রাস্তা পার হলেই পাশাপাশি দুটো পাব। একটা একটু বেশি ঝলমলে। একটু বেশি কোলাহলপূর্ণ। অপরটি আমাদের রমানাথের গলির মত। কফি হাউস, ফেভারিট কেবিনের ভীড় ছেড়ে, গ্রীষ্মের সন্ধ্যার ভীড় ভোলানো ছুটি।
আমি অবশ্য পারতপক্ষে পাবে যাই না। প্রথম দিকে বার কয়েক গেছিলাম। একটা পুল টেবিল আছে। খেলার চেষ্টা করে দেখলাম তেমন জমছে না।
পাব দুটো ছাড়িয়ে আর এক দু পা এগিয়ে গেলেই কালেকটিভো কফি হাউস। দিব্যি জনা পঞ্চাশ লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতে পারে। প্রথম প্রথম গিয়ে একটু থমকেছিলাম। সবাই তো ল্যাপটপ, বই খাতা খুলে, একদম মৌরসী পাট্টা জমিয়ে বসেছে! একদম আমাদের কফি হাউস বা ফেভারিটের মত। কতক্ষণ বসতে দেয় এখানে?
এক কাপ চা নিয়ে কঙ্কদার ফেভারিট কেবিনে ঘন্টা দুয়েকও কাটিয়ে দিয়েছ বহুদিন। হাতে পয়সা অল্প থাকলে কোনও কোনও দিন চা-ও নিইনি। এই কালেকটিভো কফি হাউসেও কি একই ব্যাপার?
এক মাগ ব্ল্যাক কফির (ইনফিউশন নাকি?) দাম ১ ডলার আশি সেন্ট। অর্থাৎ আমাদের দেশের হিসেবে ১২ টাকা মত (মনে রাখতে হবে ক্রয়ক্ষমতার হিসেবে এক ডলার প্রায় সাত টাকার সমান)।
এই টাকা বারো খসিয়ে তো বসলাম এক কাপ কফি নিয়ে। ঘন্টা, দু ঘণ্টা কুছ পরোয়া নেই। কেউ দেখতেও আসবে না। তেরছা তাকাতে তাকাতেও বেয়ারারা হেঁটে চলে বেড়াবে না (সাম্প্রতিককালে কলকাতা কফি হাউসে এই উৎপাতটা জুটেছে। বেশিক্ষণ বসার উপায় নেই আগের মত। বেয়ারারা উসখুস করতে থাকে)।
অবশ্য এখানে বেয়ারা বলে কেউ নেই। কাউন্টারে কিছু তরুণ তরুণি কাজ করছে। মোটামুটি সবাই বেশ হাসিখুশি। সবচে বড় কথা এদের ব্যাবহারে একটা অদ্ভুত সহজতা আছে। যেন সবাই খুশি মনে কাজ করছে। তারই সাথে সাথে চেনা কাস্টমারদের সঙ্গে ঠাট্টা তামাসাও চলছে। চাই কি, মাঝে মধ্যে ওরা ফ্রিতেও কফি দিয়ে দিচ্ছে।
লক্ষ করেছি যে এরা নিয়মানুবর্তিতাকে খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখে। একবার আমি লাইনে দাঁড়িয়েছি অর্ডার দেব বলে। সহসা একজন বাঁদিক থেকে আগে কাউন্টারে পৌঁছে গেল। আমি অবশ্য ব্যাপারটা তেমন খেয়ালও করিনি। কিন্তু কাউন্টারে যখন পৌঁছলাম, দেখি কফি হাউসের কর্মচারি দৃশ্যতই বিরক্ত। ‘হুট করে লাইনে ঢুকে গেলেন ভদ্রলোক। আপনি কিছু মনে করবেন না। কফির দাম দিতে হবেনা আপনাকে। এটা আমার তরফ থেকে।’ আমি কেমন থতমত খেয়ে গেলাম। ঘটনাটা যে কর্মচারিটিকে ব্যাথিত করতে পারে, তা ভাবতে পারিনি। অথচ এ মোটেই শুকনো ‘কাস্টমার স্যাটিসফ্যাকশন’ নয়। এই ছেলেটি বেশ কায়দা করে, সুর করে, কাস্টমারদের অর্ডার জোগায়। বেশ বোঝা যায় যে সে কাজটা ভালবাসে।
কফি হাউসে বিনামুল্যে ওয়াইফাই আছে। আমি অবশ্য নিতান্ত কালেভদ্রে ল্যাপটপ অথবা ফোন নিয়ে যাই। সবসময় যোগাযোগের উৎপাত ভালো লাগে না। সাধারণত যাই বই নিয়ে। অথবা এমনি গিয়ে বসি। এখনো তেমন কফিহাউস কেন্দ্রিক আড্ডার সাথি জোটেনি। তবে আমার ফ্ল্যাটবাড়ির একটা গ্রুপ আছে। সেখানের ছেলে মেয়েরা মাঝে মাঝে কালেকটিভোয় আসে। আড্ডা হয়।
কফিহাউসের লাগোয়া একটা ব্যাকরুম আছে। অনেকটা কলকাতা কফিহাউসের ‘বইচিত্র’-র মত। সেখানে মাঝে মাঝেই কবিতা, গানের আসর বসে। কিছুদিন আগে একটা কবিতার আসর হয় গেল। বাইরে বসে বসে শুনছিলাম। মনে পড়ছিল কলকাতার কথা। আমার প্রিয় কবি প্রদীপ্তর (নাম পরিবর্তিত) কথা। আমি গদ্যই বেশি পড়ি। কিন্তু কোনও এক নিঃসঙ্গ অসহ্য দুপুরে কলেজস্ট্রিটের পুরোনো বইএর দোকানে হঠাৎ খুঁজে নিয়েছিলাম শক্তির একটা কাব্য গ্রন্থ। মাত্র টাকা কুড়ি দাম। আমি বইটাকে খুঁজে পেয়েছিলাম, না বইটা আমায় খুঁজে পেয়েছিল তাই ভাবি মাঝে মাঝে। ফুটপাতে বসে গোগ্রাসে পান করেছিলাম শক্তি চট্যোপাধ্যায়ের শব্দচ্ছটা। কি নিদারুণ দুপুর ছিল সেদিন। কি উসখুসে, কি ছিন্নভিন্ন দুপুর ছিল সেদিন।
সেই থেকে আমি অল্প অল্প কবিতা পড়ি। অল্প শক্তি, সুভাষ, শামসুর রহমান। অল্প হেলাল হাফিজ। সত্যেন দত্তের অনুবাদ কখনোও বা জার্মান কবি হাইনরিখ হাইন। সুমনের কল্যাণে হঠাৎ পাওয়া অলোকরঞ্জন। সেই থেকে ‘আমি যত গ্রাম দেখি, মনে হয় মায়ের শৈশব…’। সেই থেকে প্রদীপ্তর কবিতা। সরাসরী কবি বললে প্রদীপ্তর একটু অস্বস্তী হয়। অতএব ছদ্মনাম। কফি হাউসের ব্যাকরুমে কবিতার আসর শুনে তাই মনে পড়ল প্রদীপ্তর কথা। যেমন ছবির প্রদর্শনী দেখে মনে পড়ে শৌভিক, শ্রমণা আর অমলেন্দুর (নাম পরিবর্তিত) কথা। অথবা আঁকার সরঞ্জাম দেখলে সেমন্তির কথা।
কালেকটিভো কফি হাউসের বাইরে মাঝে মাঝেই কিছু গৃহহীন মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়। তারা কখনো বা এক ডলার অথবা এক কোয়ার্টার ভিক্ষা চায়। কখনোও দিই। কখনোও দিই না। বছর পাঁচেক আগে যখন এদেশে এসেছিলাম, তখন এক পাঞ্জাবি বন্ধু আমায় শিখিয়েছিল, ‘সাহেব ভিখিরিদের সবসময় কিছু না কিছু দিবি। এতে নিজের প্রতি একটা কনফিডেন্স আসবে!’ আমি তো শুনে বেশ খানিকটা থতিয়ে গেছিলাম। এ বার কি যুক্তি? পরবর্তী কালে যতবার কোনও ‘সাহেব’ ভিখিরির সাথে মোলাকাত হয়েছে ততবার মনে পড়েছে কথাটা। একথা সত্যি যে, এ দেশে যে ভারতীয়রা আসে তাদের বেশিরভাগের মধ্যে একটা অদ্ভুত দৈন্য কাজ করে। যদি কোনও ভাবে গ্রিনকার্ড পাওয়া যায়! যদি কোনও ফিকিরে এখানে থেকে যাওয়া যায়! সবার মধ্যে নয়। তবে অনেকের মধ্যে।
ব্যাপারটার মধ্যে একটা অদ্ভুত হ্যাংলামো আছে। এমনিতে আমি কারোর আমেরিকায় থেকে যাওয়ার বিরোধী নই। যদি ভাল লাগে, যদি কাজে কর্মে সুবিধা হয়, তাহলে পৃথিবীর যেখানে ইচ্ছা, সেখানেই থাকা যেতে পারে। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ উপন্যাসে ‘জন্মভূমি’ কাকে বলে সে বিষয়ে একটা চমৎকার কথা লিখেছিলেন। হুবহু মনে পড়ছে না। কিন্তু মোদ্যা কথাটা হল, যেখানে তোমার সহজাত অনুভুতির সহজ উন্মেষ ঘটতে পারে, সেই তোমার জন্মভূমি। অতএব আমেরিকায় থেকে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে আমার কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি হ্যাংলামিটা নিয়ে।
সম্প্রতি এখানে থ্যাঙ্কসগিভিং বলে একটা পরব হয়ে গেল। কয়েকটি ভারতীয় পরিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় ছাত্র ছাত্রীর জন্য কিছু খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছিলেন। মাঝেমাঝেই এরা আমাদের নেমন্তন্য করে থাকেন। পার্টি গুলোর একটা নির্দিষ্ট ছক আছে। প্রথমে সবাইকে নেম ট্যাগ দিয়ে দেওয়া হয় (একটা কাগজ যেটায় নিজের নাম লিখে শার্টে অথবা গ্লাসে সাঁটিয়ে দিতে হবে)। তারপর থাকে কিছু গেমস (কি কি গেমস হতে পারে, তা আগে থেকেই প্ল্যান করা)। সবশেষে খাওয়া দাওয়া। খাওয়া দাওয়ার আগে সকলে প্রার্থনা করেন (পরিবারগুলি খ্রিষ্ঠান)। হয়তবা এই প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা ধর্মপ্রচারের সুপ্ত ইচ্ছাও ওদের আছে।
আমার কিন্তু এ তেমন খারাপ লাগেনা। যদি কেউ কোনও মতবাদে বিশ্বাস করেন, তাহলে তিনি তার প্রচার করতেই পারেন। অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে গোটা আয়োজনটায় একটা ‘কৌশল’-এর জীর্ণ ছায়া আছে। এমনি ছাত্র ছাত্রীরা সপ্তাহ ভোর রান্না করে অথবা বাইরে খেয়ে একটু বেহাল থাকে। অতএব তাদের ডেকে ডুকে ভারতীয় খাবার পেট ভরে খাওয়াতে খাওয়াতে প্রভু যীশুর কথা বললে, কেমন যেন একটা অন্তর্নিহিত নীচতার ইশারা থেকে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি এদের তেমন দোষ দিইনা। এসমস্ত ‘উদ্দেশ্য’ ছাড়াও এদের মধ্যে একটা শুভচিন্তা কাজ করে। সেটা ধর্মের হাত ধরেই হয়ত আসে। তা আসুক। এরা সত্যিই ভাবেন, যে সব ছেলে মেয়ে ঘরদোর ছেড়ে এত দুরে আছে, তাদের যদি কালেভদ্রে একটু খাওয়ানো যায়, একটু সঙ্গ দেওয়া যায়, তাহলে হয়ত ছেলেমেয়েদের সত্যিই ভাল লাগবে। এবং তা লাগেও। আমাদের কলকাতায় ঠিক এমন ব্যবস্থা নেই। ভিনরাজ্য অথবা ভিনজেলার মানুষরা এসে যে একটু (অথবা একটূর বেশি) বিপাকে পড়েন না তা নয়। কিন্ত বন্ধু জুটেও যায়। আমেরিকায় যতটা আয়োজন লাগে বন্ধু জোটাতে, কলকাতায় ততটা নয়। কলেজস্ট্রিটের হিন্দু হোস্টেলে যেমন মণিপুরের ছাত্রদের হ্যারাসও হতে হয়েছে, তেমনি কাঁধে হাত রাখার মত, প্রতিবাদ করার মত চারজন বন্ধু জুটেও গেছে। কোথাও যেন সেই বন্ধুতার মধ্যে একটা সাবলীলতা আছে যা এখানকার আয়োজনের কৃত্রিমতায় খানিকটা হলেও মার খায়। তবু এখানকার মানুষ চেষ্টা করেন নবাগতদের অভ্যর্থনা জানানোর। চেষ্টা করেন বন্ধু হওয়া। এই বা কম কি।
কালেকটিভো কফি হাউস হোক বা কোনও আমেরিকান ভারতীয়র ড্রয়িংরুম, এখানে সহৃদয় হাসিখুশি মানুষের অভাব নেই। রাস্তা ঘাটে, বাসে, ডেকে কথা বলার লোকও জুটে যায়। সাধারণ পথচলতি মানুষও খুব হেল্পফুল। এঁরা কর্মঠতাকে শ্রদ্ধা করেন। নতুন আসা মানুষদের অভ্যর্থনা জানাতে চান। বেশিরভাগ দোকানি তাদের কাস্টমারদের সাথে খুব ভদ্র ব্যবহার করেন। প্রথমেই খদ্দেরকে চোর ভাবেন না। খদ্দেরও ভাবে না যে এই বুঝি আমায় ঠকিয়ে দিল। সে দিক থেকে দেখলে, এখানকার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে একটা সহজ স্বাভাবিক ভাব আছে যেটা সত্যিই খুব ভাল লাগার মত।
অথচ এই সমস্ত কিছুর মধ্যে একটা অপরিসীম একঘেয়েমিও আছে। মাসের পর মাস বেড়িয়ে যায় হিসেবের ছকে। প্রাচুর্য্যের মধ্যে, আপ্যায়নের মধ্যে, কর্মব্যাস্ততার মধ্যে সবসময়ে একটা বাঁধা ছক টিক টিক করে বাজে। ‘রিভোলিউশনরি রোড’ সিনেমাটা দেখেছিলাম কত বছর আগে। আমেরিকার জীবনযাত্রার এই দিকটা সিনেমার পরতে পরতে রাখা আছে।
আমি এদেশে যত নদী দেখি, পাহাড় দেখি, শহর, গ্রাম, রাস্তা দেখি, সব কেমন যেন এক একই হয়ে আসে। দিনের পরে রাত আর রাতের পরে দিন। একটা প্রাথমিক চোখ ধাঁধানো বৈভবের পর দৃশ্যমান হয় নিতান্ত ছকে বাঁধা জীবন।
ভারতবর্ষে এই রোগের ওষুধ অন্তত কিছুটা হলেও এখনো আছে। এখনও চূর্ণী আর মাতলা আলাদা আলাদা নদী। এখনও দার্জ্জিলিং আর কল্যাণি আলাদা আলাদা শহর। এখনও ফেভারিট আর কফি হাউস আলাদা আলাদা দেশ।
এখনো আমার শহর আমার দারুচিনি দ্বীপ।