যা থেকে গেছে (অচিন দেশে – ৫)

১৯৫৩ সালের বৈশাখে এক সাতাশ বছরের যুবক ডালহৌসির সুইট হোমের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটু থমকালো। ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সামনে পরাণ চক্রবর্তী দাঁড়িয়ে আছেন। তার পাওনা সাড়ে তিন টাকা। এ বাদ দিয়ে ট্রামভাড়া এক আনা, মুদির দোকানে বাকি আড়াই টাকা আর বাসাভাড়া দেড় টাকা।

মোট খরচ সাত টাকা তিন আনা। পকেটে আছে ঠিক আটটা টাকা। যুবক হিসেবটা আরো এক বার মগজে আঁতি পাঁতি করে খুঁজে নিল। এখনঅবশিষ্ট একটি আনার জন্যে লড়ছে তার দুপুরের খাবার আর সদ্যজাত কন্যার জন্য একটু দুধ আর ফল। যুবকটি অসম্ভব কর্মব্যাস্ত মধ্যাহ্নে প্রায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ফুটপাতের ধারে। চমক কাটলো পথচলতি মানুষের গালাগালিতে, ধাক্কায়। ‘চুলোয় যাক ট্রাম ভাড়া। হেঁটে মেরে দেব’। যুবক সুইট হোমে ঢুকে পড়ল।
১৯৫৩ সাল। দেশ স্বাধীন হওয়ার ছ’বছর পর, কাকদ্বীপের চন্দনপিঁড়ি গ্রামে আসন্নপ্রসবা অহল্যার তেভাগার দাবিতে প্রাণ দেওয়ার চার বছর পর, সত্যজিৎ রায় পথের পাঁচালির শ্যুটিং শুরু করার ঠিক এক বছর পর, উত্তম-সুচিত্রা জুটির ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ আত্মপ্রকাশ করেছে যে বছর, সেই ১৯৫৩ সালের কথা। সেই সাতাশ বছর বয়সী যুবকের কথা, যে আইন পাশ করে, স্বাধীন ভাবে কাজ করার স্বপ্ন দেখছিল। স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে সংসার পেতেছিল মধ্য কলকাতার এক উদবাস্তু আবাসনে। সে আবাসন গুলোয় তখন পুব বাংলার সব হারানো মানুষদের ভীড়। দেশ ভাগের যন্ত্রণা, বেপরোয়া কালোবাজারি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বগ্রাসী ধ্বংসলীলা। সব মিলিয়ে এক সুকঠিন বাস্তব যখন সমস্ত স্বপ্নকে চুরমার করে দিতে উদ্যত, যুবকটি দুম করে এক সাহেব কোম্পানির বাঁধা চাকরি ছেড়ে দিলে। কি ব্যাপার? না, সে স্বাধীন ভাবে আইন ব্যাবসায় নামবে।
না আছে মুরুব্বির জোর, না আছে টাকার জোর। আত্মীয় পরিজন হা হা করে উঠলে। শ্বশুরবাড়িতে ঠাট্টা টিটকিরি, ঠেস দিয়ে কথা শুরু হল। যুবকটির জেদ যেন আরো বেড়ে গেল।
কিসের জেদ এত? সাধারণ স্বাভাবিক পথ ধরে চললে যেখানে মোটামুটি স্বচ্ছল জীবন যাপন করা যায়, তখন কেন একজন কঠিন, অনিশ্চিত জীবনের দিকে যেচে এগিয়ে যায়? ‘কারো গোলাম হব না, নিজের মত আইন ব্যাবসা করে, নিজের চেষ্টায় বড় হব’। শুধু এটুকু স্বপ্নই কি যথেষ্ট?
কিসের জেদে একজন বত্রিশ বছরের তরুণ বাঁধা চাকরি ছেড়ে বউএর গয়না বেচে সিনেমা বানাতে শুরু করে? সে গত বছর কাজ শুরু মাত্র করেছে। কাজ শেষ হয়ে সিনেমা বেরুতে বেরুতে আরো দুবছর লাগবে। ‘৫৫ সালে ‘পথের পাঁচালি’ হয়ে সিনেমার ফিল্ম গুলি আত্মপ্রকাশ না করা অবধি সে উন্মাদ বই তো আর কিছু নয়।
এক একজন মানুষের এক এক রকমের স্বপ্ন। এক এক ধরণের জেদ।
চন্দনপিঁড়ি গ্রামের অহল্যা গর্ভে সন্তান নিয়ে মিছিলে হেঁটেছিল কিসের তারসে? যে জমিতে সে আর তার মরদ চাষ করে ফসল ফলায়, সেই অন্নের তিন ভাগের এক ভাগ আদায় করবে বলে? অহল্যা প্রাণ দিয়েছেন তাও চার বছর হয়ে গেছে। ‘৪৯ সালে। তার স্বপ্ন, তার জেদ ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে, দেহ ধরছে মাত্র।
কারো থাকে ভাতের স্বপ্ন, কারো থাকে হকের স্বপ্ন, কেউ বা ভাবে শিল্পি হবে, বিপ্লব করবে। ১৯৫৩ সালের বৈশাখের সকালে সেই যুবকটি নিতান্ত বেপরোয়া ভাবে তার মত করে কিছু স্বপ্ন দেখছিল। কিছু হঠকারিতার জন্য মনটাকে টান টান করছিল। সাদামাটা ভাবে জীবনটাকে সে রাখবেবে না। তার জন্য কিছু ক্ষতি হয় হোক।
পরের ষাটটা বছর কখনো টাকার চিন্তায়, কখনো সাফল্যের উচ্ছাসে, কখনো গভির অশান্তিতে কেটেছে। যুবক ধীরে ধীরে প্রৌঢ় হয়েছেন। পাঁচ সন্তানকে বড় করতে করতে কখন যে বয়েস আশি পেরিয়ে নব্বই ছুঁয়েছে তেমন টের পাওয়া যায়নি। তার জিত হয়েছে কি?
১৯৮৫ সাল। রঙ ওঠা শার্ট পড়া তরুণটি কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল টেন্ডারের কথা। বন্ধু আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। এবার সব ঠিক ঠাক লেগে গেলে, লঞ্চের ব্যাবসার গোড়াপত্তন হয়ে যাবে নির্ঘাত। ২০১৫ তে এসে আমরা জানি যে তার লঞ্চের ব্যাবসা, কিংবা ব্রিজ বানানোর ব্যাবসা বিফলে গেলেও, সে শেষমেশ ঠিকই দাঁড়িয়ে গেছিল। দুই বোনের বিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ভগিনীপুত্রর স্কুলের ডোনেশন জোগাড় করা অবধি সমস্তই সে করতে পেরেছিল তার নিজের শর্তে। স্বাধীন ব্যাবসার সাধ মেটাতে মেটাতে। হঠকারি হতে হতে হতে। না, সেও চাকরি করতে চায়নি কোন অজানা টানে। স্বাধীন ব্যাবসা করে সে দাঁড়াবে, এই তার স্বপ্ন।
১৯৯৩ সাল। মেয়েটি চোয়াল শক্ত করে, শিশুপুত্রের হাত ধরে রাস্তায় নেমে এল। চাকরি নেই। ফেরার জায়গা বলতে বাপের বাড়ির দু কামরার ফ্ল্যাট। সেখানেও জায়গা নিতান্ত অপ্রতুল। সিএ ইন্টারমিডিয়েট অবধি এক চান্সে পাশ করার পর বিয়ে হয়ে গেছিল। ফাইনালটা আর দেওয়া হয়নি।
হতে পারে হাতে চাকরি বাকরি নেই, হতে পারে নাবালক সন্তান কি ভাবে মানুষ হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবু মেয়েটির স্নায়ু বজ্রাদপী সুনীচ। সে হারবে না। পরের বিশটা বছরে, সে একা হাতে ছেলে মানুষ করবে সমাজের ভ্রুকুঞ্চনের পরোয়া না করে, বয়েসের ভার আর রোজগারের লড়াই সামলে ঠিক সিএ ফাইনাল পাশ করে যাবে শেষমেশ। কিসের অমোঘ টানে সেও চাকরির বদলে স্বাধীন পেশাকেই বেছে নেবে একদিন।
২০০৮ সাল। বছর আঠারোর কিশোর আমেরিকা ছেড়ে বাড়ি ফিরবে পড়াশোনা মাঝ পথে ছেড়ে। মার্কিণ দেশের ভোগ সর্বস্ব জীবন নাকি তার অসহ্য লাগছে। দেশে ফিরলেই অসংখ্য প্রশ্ন চিহ্ন তাকে ঘিরে ধরবে। আমেরিকা থেকে কেউ ফেরে না। অন্তত এই ধরনের বোকা কারণে তো নয়ই। সে পারবে কি?
পারবে কি পরের বছর গুলোয় অর্থনৈতিক লড়াই গুলোয় জিততে, পারবে কি নিজের শর্তে গণিত নিয়ে পড়তে, পারবে কি প্রতি সপ্তাহে হাজার কিলোমিটার ট্রেনের জেনারেল কামরায় যাতায়াত করে একটা স্বাধীন ব্যাবসা দাঁড় করাতে?
২০০৮ সালের কিশোরটি অপেক্ষা করছিল, ১৯৫৩র যুবকেরর জন্য, ১৯৮৫র তরুণের জন্য, ১৯৯৩র যুবতীর জন্য । কিছুটা স্বপ্নের জন্য, কিছুটা হঠকারিতার জন্য, কিছুটা সাহসের জন্য। সে যুবক, সে তরুণ, সেই যুবতী যদি পেরে যায় তবেই হয়ত এই কিশোরও পারবে।

1 Comment

  1. DEBARATI DATTA GUPTA says:

    যে কিশোরের সামনে এমন যুবতী, এমন তরুণ, এমন বৃদ্ধ আছেন তার স্বপ্ন সফল হবেই।

    Like

Leave a Comment

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.