‘অভিযান’ দেখে, খাতা পেন নিয়ে লিখতে ইচ্ছা করল। মনে হলো কলমের আঁচর আসল কাগজে ফুটিয়ে তোলা দরকার। মিতব্যয়ী হওয়া দরকার। ‘কাটব, লিখবো, আবার কাটবো’ – বলার অধিকারী হওয়া দরকার।
‘অভিযান’ নবজাগরণ উত্তীর্ণ বাঙালি যুবকের অস্থির বিচরণের গল্প। সেই যুবক, যে অসহ্য অস্বস্তী নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে, “এর চেয়ে নির্জন জায়গা আর আছে?” অতলান্ত মরুভূমির বুকে তার প্রতিবিম্ব উত্তর শানায়, “হ্যাঁ নিজের ভেতরেই আছে।” ছায়াছবিতে এমনি কথপোকথন ঘটছিলো সৌমিত্র আর সত্যজিতের মধ্যে। আর দর্শকাসনে বসে ভাবছিলাম, এই যুবকদের দলে যেতে হবে। ভাবছিলাম যে ‘আমি’ এই যুবকদের কেমন একটা বদখত approximation হয়ে রয়ে গেছি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের গল্প বলেছেন পরমব্রত। বলতে বলতে ন্যারেটিভ ছাপিয়ে গেছেন অল্প আয়াসে। আমরা পরম-সৌমিত্র-র হাত ধরে, বিংশ শতাব্দীর বাঙালি যুবকের নিবিড়তম অন্ধকার, উজ্জ্বলতম নক্ষত্রে পৌঁছে গেছি।
ছবি যে পথে চলেছে তাতে ‘ক্লিশে’ গুলো ক্রমশ লঘু হয়ে এসেছে। সৌমিত্র-উত্তম, পরকীয়া, শিশির-সত্যজিত – এ সব কোলাহল স্তিমিত হয়ে এসেছে। আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি সেই মানুষটার যার একমাত্র খুঁটি, ‘নিজের কাজের প্রতি কখনো অসৎ হইনি।’ তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
যীশু সেনগুপ্ত যুবক সৌমিত্র-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। মুশকিল হলো, যে শিক্ষা, বুদ্ধি আর অন্তর্মুখিনতার ত্রহ্যস্পর্শে সৌমিত্র নির্মিত, যীশুর জীবনে তার প্রয়োগ অনুপস্থিত। অতএব পঞ্চাশ থেকে সত্তরের যে বর্ণময় কলকাতা, যার বিভা, যার চেতনা, যার বিদ্রোহ সৌমিত্র-র মুখে প্রতিফলিত হওয়া উচিৎ, শক্তি, সুনীল, সন্দীপন-মহাবিশ্বের যে অংশিদারী দৃষ্টিপাতে থাকা উচিৎ, যীশুর মুখে চোখে তা হয়নি। শপিং মল গোছের চাউনিতেই থেমে গেছে। ইংলিশ মিডিয়াম-গ্রিনকার্ডের উমেদারী-গাড়ির ব্র্যান্ডের মধ্যযুগীয় identity-তে আটকে গেছে। তুলনায় উত্তমের ভূমিকায় প্রসেনজিত অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য।
ছবি-কে অবশ্যই ধরে রেখেছেন সৌমিত্র স্বয়ং। পাওলি দাম, বাসবদত্তা, কিউ আর পরমব্রত, নিজস্ব পরিসরে ভালো কাজ করেছেন। বাসববত্তার কাজ আরো দেখতে ইচ্ছা করে।
‘অভিযান’ দেখে মনে হয়, পরমব্রত-র ভেতরটা, বাংলার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিপুল দায়ভার ভেঙে, ধীরে ধীরে মুক্তি পাচ্ছে। এখনো ছবির মধ্যে নেটফ্লিক্স গোছের মোলায়েম ভাব আনার একটা চেষ্টা রয়েছে। কিন্তু এসবের আড়াল থেকে উন্মুক্ত উড়ানের সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে।
এই ছবিটা দেখে আসুন। পরমব্রত আরো আরো ভালো কাজ করতে চলেছেন।