বড় বিপদটা কোথায় – সুগত বসু, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক – আনন্দবাজার

জানুয়ারি ২০২১

প্রজাতন্ত্র দিবসের আগে ঘরোয়া আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গ, ভারত বিশ্ব নিয়ে নানা চিন্তা এবং উদ্বেগের কথা বললেন মানবিকবিদ্যার তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এবং ইতিহাসবিদ সুগত বসু

আপনারা দু’জনেই প্রথমে কাজের সূত্রে, পরে জীবনের সূত্রে প্রবাসী। কিন্তু প্রবাসী হয়েও দু’জনেই বাংলায় কাজ করেছেন, এক জন সামাজিক কাজ, অন্য জন রাজনৈতিক কাজ করার সূত্রে বাংলা ও বাঙালির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। একটা অন্য রকম জানালা আছে আপনাদের দু’জনেরই। কী মনে হচ্ছে এখন, পরিস্থিতি কি বদলাচ্ছে, বাংলার?

সুগত বসু: অবশ্যই বদলাচ্ছে। আগে বলি, আমি বাংলায় তিন ধরনের কাজ করেছি। গবেষণার সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের জেলায় জেলায় ঘুরে গ্রামীণ অর্থনীতি, সমাজ বোঝার চেষ্টা করেছি। রাজনীতিও। পশ্চিমবঙ্গে তখন বর্গা রেজিস্ট্রেশন চলছে। রেজিস্ট্রেশন ক্যাম্পে যেতাম, মেদিনীপুরে, বর্ধমানে, পশ্চিম দিনাজপুরে। তখন রাজনীতি ছিল স্পষ্টতই শ্রেণিভিত্তিক। যদিও আমার মনে হয়েছিল, যাঁরা চাষ করেন বর্গাদার তো তাঁদের ৫%; যাঁরা খেতমজুর, তাঁদের সম্বন্ধে কমিউনিস্টরাও যথেষ্ট চিন্তা করছেন না। যাঁদের অল্প কিছু জমি আছে, ছোট চাষি, তাঁদের সমর্থনের উপর ভিত্তি করা হচ্ছে, পঞ্চায়েত হওয়াতে সেটা জোরালো হয়েছিল। আমার অন্য একটা কাজ অবশ্যই নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো ও নেতাজি ভবন। সেটা আমার বাবা-মায়ের কাজ, প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন তাঁরা। নেতাজির সহযোদ্ধাদের দেখেছি, দেখেছি তাঁদের মূল্যবোধ বা ভাবাদর্শ— এই সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের কতটা ঊর্ধ্বে তাঁরা। তৃতীয়ত, ২০১৪’য় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বললেন সংসদের নির্বাচনে দাঁড়াতে। রাজি হলাম, কারণ মনে হয়েছিল ভারতবর্ষ খুব বড় রাজনৈতিক বিপদের সামনে। কংগ্রেস ধসে যাচ্ছে, বিজেপির বিপদকে আটকাতে হলে আঞ্চলিক দলগুলিকে ভাল ফল করতে হবে। সে বার বিজেপি জিতেছিল, যেটা এক দিক থেকে ২০১৯-এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বহু বছর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অচ্ছুত, ‘পারায়া’ থাকার পর সে বারই রাষ্ট্রক্ষমতার সূত্রে একটা গ্রহণযোগ্যতা, বৈধতা পেলেন নরেন্দ্র মোদী। পরের পাঁচ বছর চেষ্টা করেছি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে ধর্মের দিক দিয়ে সংখ্যাগুরুবাদের উত্থানের নীতিগত বিরোধিতা করতে। বলেছি, এটা কোনও গণতন্ত্র নয়, নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগুরুবাদ। ঐক্য আর একত্বকে গুলিয়ে ফেলা। ইউনিটি-র বদলে ইউনিফর্মিটি।

সূর্য: পশ্চিমবঙ্গে ৪৪৪০টি স্কুল রয়েছে। পুরুলিয়া ৩৯০, বীরভূম ৩৬০, বাঁকুড়া ২৭০, মেদিনীপুর ৩৬০, নদিয়া ৩০০, মুর্শিদাবাদ ২৭০, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ৩০০, উত্তর ২৪ পরগনা ৩৯০, মালদহ ২৭০, দক্ষিণ দিনাজপুর ৩৬০, উত্তর দিনাজপুর ২৭০, কোচবিহার ৩০০, আলিপুরদুয়ার ৩০০, নকশালবাড়ি ৩০০। এই স্কুলগুলিতে মোট শিশুর সংখ্যা ১০৬৭৭০। আর ভারত ও নেপাল মিলিয়ে ১০২৭০২ স্কুল, শিশুর মোট সংখ্যা ২৭৮৪৮০৬।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: তা হলে চিন্তা করে দেখো, কী ধরনের ভোটিং বেস তৈরি হয়েছে।

সুগতদা বলছিলেন, দেশভাগের পর অচলাবস্থা তৈরি হলেও বিভক্ত বাংলায় চট করে একটা স্থিতি নিয়ে এসেছিল উদ্বাস্তুদের নিয়ে বাম রাজনীতি। আর গায়ত্রীদি বলছেন কী ভাবে বাম রাজনীতি লোকসংযোগের কাজটা করতে পারল না, ব্যর্থ হল মানুষের কাছে পৌঁছতে। আর তার থেকে আজকের এই সঙ্কট।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: একেবারেই। একটা গল্প বলি। সে দিন এক বুড়ো লোক বলল, “দিদি, আজ আমার জুতো। জানেন তো, আমরা অচ্ছুত, বয়স যখন কম ছিল, পায়ে জুতো দেখলে বেত মারত।” বললাম, “বদলাল কে?” উত্তর দিল, “পার্টি।” এই দেখো। এই হল পার্টি। আর আজকে কিনা পার্টি মানে শুধু কে জিতল কে মরল! খালি মারামারির জন্যই পার্টি। এখন খবর: সিপিএম পার্টি মানুষকে বলছে, “ওই দলে যোগ দে, তবে আমাদের দল আবার দাঁড়াতে পারবে।” সারা জগতেই এখন বাম-ডান জোট, কারণ বামেদের আর কোনও দাঁড়াবার প্ল্যাটফর্ম নেই। এটা সত্যিই বিরাট পরিবর্তন।

আমার মতে, আমাদের দেশে বাম পার্টি ভয়ানক রকম ভাবে ‘শ্রেণি’তে আটকে গিয়েছিল, উঁচু শ্রেণির মধ্যে। শুধু তত্ত্বেই তারা বন্দি হয়ে থাকল। তত্ত্বগত ভাবে চমৎকার উত্তর দেয়, অথচ নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর প্রমাণ— পার্টি জানেই না কী করে নীচের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে হয়। এত দিন বামপন্থায় থেকেও এরা চিন্তার দিক থেকে আসলে সামন্ততন্ত্রেই পড়ে আছে, উপরটা নীচের সঙ্গে কথা বলতে জানে না!

সুগত বসু: আমি কিন্তু গায়ত্রীদির থেকে শিখেছি কী ভাবে কথা বলতে হয়। ভেবেছি, কী করে যোগাযোগ স্থাপন করব বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী ও বৃহত্তর শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যে। আমার অনেক বক্তৃতাতে গায়ত্রীদির থেকে ধার করে অনেক সময় বলেছি, খেটে খাওয়া মানুষ কারা? আপনারাই আসল, কারণ আপনারা গতর খাটান। আর আমি কেবল মাথা খাটাই।

বিষয়টা খুব সহজ নয়। যখন সংসদীয় রাজনীতিতে ছিলাম তখন ভেবে নেওয়া কঠিন ছিল না যে, ওটাও আর এক রকম ক্লাসরুম। কিন্তু আসল ক্লাসরুমটা তো একেবারে অন্য— বারুইপুর, সোনারপুর, ভাঙড়ে কৃষকদের সভা, যেখানে বক্তৃতার জন্য, যোগাযোগের জন্য আমাকে ভাষা খুঁজতে হয়েছে। ওই ভাষাটার কিন্তু খুব অভাব, সেটার জন্য আমাদের ভীষণ চেষ্টা করতে হবে।

আর একটা কথা। বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলা ঐতিহ্যের উপর বড় একটা আঘাত আসছে। বাংলার রাজনীতিতে কিন্তু একটা ‘বড়’ স্রোত ছিল, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শরৎচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসু। অন্য দিকে একটা ‘ছোট’ সঙ্কীর্ণ ধারা ছিল, হিন্দু মহাসভার, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে। দ্বিতীয় স্রোতটাই ১৯৪৭-এ আমাদের সর্বনাশ ডেকে আনে। ২০২১-এ এঁদের জন্য আবারও আমাদের এত দিনের সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে, আর একটা সর্বনাশ হতেই পারে। যাঁরা বলছেন, “আরে আমরা কংগ্রেসও দেখেছি, সিপিএমও দেখেছি, তৃণমূলও দেখেছি, বিজেপিও নাহয় দেখব”, তাঁরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারছেন না বিজেপি কত ভয়ঙ্কর।

প্রসঙ্গত, সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতটাও মনে রাখতে হবে। কোনও দলই ‘পারফেক্ট’ নয়, অনেক ভুলভ্রান্তি, অনেক দুর্নীতি। কিন্তু তার মধ্যেও সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এবং গোলকায়ন, বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে দেশের বাকি অংশের সঙ্গেও কতকগুলো যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: খুব জরুরি কথা। এই যে তিনটি কৃষি বিল, এর মধ্যেই আছে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা, অর্থাৎ গোলকায়নের কুফল। শুধু এ দেশে নয়, বিশ্বের সর্বত্র, এমনকি আফ্রিকাতেও এই ভাবেই ব্যাপারটা ঘটতে দেখেছি। কোনও জাতিরাষ্ট্র এখন একলা দাঁড়িয়ে নেই, যদিও সমানে জাতিরাষ্ট্র হিসেবেই দেখানো-বোঝানো হচ্ছে। কোভিড দেখিয়েছে, সম্পদের পুনর্বণ্টন লাগবে, ‘ইউনাইটেড সিটিজ়েন’ হতে হবে। খালি ‘বাংলা বাঁচাও’-এ পড়ে থাকলে তো হবে না। দুটোকে জুড়তে হবে।

কথা হল, কী করা যায়। মার্ক্সীয় বিপ্লবগুলি জনসম্মতির অভাবে কী ভাবে নষ্ট হয়ে গেল, সে তো আমরা দেখেছি। বক্তৃতা নয়— কাজটা করে করে এগোলে তবেই গণতান্ত্রিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সাহায্য করা সম্ভব। সামাজিক ভাবে ন্যায়সম্মত পৃথিবীর দিকে যাওয়া সম্ভব।

সুগত বসু: আপনি যে বাংলার গ্রামীণ সমাজের কথা বলার আগেই বললেন কৃষক আন্দোলন হচ্ছে, দিল্লি ঘিরে ফেলেছে, ‘দিল্লি চলো’ ধ্বনি দিয়ে আন্দোলন হচ্ছে, সেটা থেকেই বোঝা যায় আমরা শুধু ‘বাংলা বাঁচাও’-এর কথা বলছি না। আসলে কৃষি-কাঠামো বিভিন্ন রাজ্যে কিছুটা আলাদা হলেও কতকগুলো যোগাযোগ স্থাপন খুবই সম্ভব। এমনকি গুজরাতেও কিন্তু গভীর সঙ্কট। কেবল মোদী-শাহের রাজত্বই তো নয়, তাদের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রেখে চলে এমন আর একটি জুটির রূপ সেখানেই স্পষ্ট দেখেছি। গুজরাতে গিয়ে দেখে অবাক হয়ে গেলাম যে, সেই রাজ্যের প্রতিটি সমুদ্রতীর দু’টি বড় ব্যবসায়ী সংস্থার হাতে বিকিয়ে দেওয়া হয়েছে, অম্বানী এবং আদানি।

বাংলায় রাজনীতি করতে গিয়ে সব সময় শুনতে হয় যে, আঞ্চলিক দলগুলো বড় দুর্নীতিপরায়ণ। অত্যন্ত সঙ্গত অভিযোগ, সন্দেহ নেই। কিন্তু অন্যান্য রাজ্যে, বিশেষ করে গুজরাতে এই দুর্নীতির বহর ও ধরনটা (‘স্কেল অব করাপশন, লিঙ্কড টু ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম’) দেখলে স্তম্ভিত হতে হয়। গোটা শাসনতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। অতিমারির মধ্যেও ছয়টি বিমানবন্দর আদানিরা দখল করেছে। জিভিকে-র মতো সংস্থা থেকে মুম্বই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও তারা হস্তগত করেছে। অথচ এই গুজরাতেও কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর আশা আছে। কয়েকটা বড় সভায় বক্তৃতা ও আলোচনার সূত্রে বুঝলাম, সে রাজ্যের নাগরিক সমাজ অনেক দিক দিয়েই খুব সক্রিয়, ‘ভাইব্র্যান্ট’, প্রতিবাদী। অথচ, শুধু ভোট রাজনীতির দিক দিয়ে দেখলে, কংগ্রেস বা বিরোধী বলে আর কিছু নেই বলে সেখানে বিজেপির উল্টো দিকে কেউ দাঁড়াতেই পারছে না।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: সংযুক্ত নাগরিকত্বের শিক্ষাটা খুব দরকারি, কোভিড তা আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিয়েছে। নীচের মানুষের জন্য ‘বাংলা বাঁচাও’ বলে কাজ করার দরকার। কিন্তু অন্য রাজ্যগুলির সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, না হলে সংযুক্ত নাগরিকত্ব করা যাবে না। পুঁজিকে কী ভাবে লাগামের মধ্যে রাখা যায়, সীমাহীন ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত ভোগবৈভবের বাইরে আনা যায়, সেটাই আমাদের শিক্ষা হওয়া উচিত।

সুগত বসু: এখানেই আসে ব্যবহারিক রাজনীতির প্রশ্ন। আমেরিকাকে দেখে আজ আমরা একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছি। জো বাইডেনকে নিয়েও অনেকেই উৎসাহিত নন, কিন্তু ভাবতে পারছ, ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি আরও চার বছর রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিয়ে ছেলেখেলা করতেন, কী হত? ঠিক তেমনই আমাদের দেশেও মোদী-শাহ রাজের পরিস্থিতি। এই যেমন, আজ মহারাষ্ট্রে বিজেপি নেই বলে আমরা অনেক কিছু জানতে পারছি, নির্বাচনের আগে সংবাদমাধ্যমকে কী ভাবে কব্জা করে রাখা হয়েছিল জানতে পারছি।

বড় বিপদটা কোত্থেকে আসছে সেটা মনে রাখতে হবে। বাংলাতেও। ঠিক এই মুহূর্তে, আমরা কোনও ‘আদর্শ বিকল্প’ মানুষের সামনে রাখতে পারব না, অন্তত কয়েক মাসের মধ্যে তো নয়। অথচ একটা খুব বড় বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করতেই হবে। দেশে অন্তত চারটে খুব গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন আসছে। সেই সব রাজ্যে যদি এমন সরকার গড়া যায়, যা কেন্দ্রীয় সরকারের চেয়ে আলাদা বা তার বিরোধী, তবে তার ভিত্তিতে ২০২৪-এ সারা ভারতবর্ষে সত্যি একটা বিকল্প দাঁড় করানো যেতে পারে। কথাটা মাথায় রাখা খুব দরকার।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: আমাদের বিপদ কিন্তু অনেক বেশি। মোদী ট্রাম্পের মতো অত বোকা নন। যথেষ্ট রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আছে।

সুগত বসু: সে তো বটেই। সারা জীবন রাজনীতি করেছেন। ট্রাম্পের তো নিজের কিছু নীতি-আদর্শ ছিল না। মোদীরা একটা বিশেষ নীতিতে ‘কমিটেড’।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: একটা আন্তর্জাতিক সমর্থনও আছে। আমাদের বিপদ অনেক বেশি। শুধু বাঙালি ভদ্রলোক হয়ে বসে না থেকে বাংলার পুরোটা নিয়ে ভাবা দরকার, দলিতদের কথাও। সে-সব চিন্তাভাবনা করছি কি?

ইউনিভার্সিটি প্রফেসর ইন দ্য হিউম্যানিটিজ়, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি; গার্ডিনার প্রফেসর অব হিস্ট্রি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি

সূত্রধর: সেমন্তী ঘোষ

তথ্যসহায়ক: সূর্য পারেখ

জাদুকর আছে জানি

একটা অপার্থিব মুহুর্তের জন্য,
ঘুম থেকে উঠে পড়ি।
যা হয়নি,
যা হতে পারে,
যা কখনো হবে না বলে শিউরে উঠি,
এই অতলান্ত জীবনে যা কোনো দিন ঘটবে বলে নীরবতা আসে,
তার জন্য,
সেই তার জন্য,
থেমে যাই।

আমাদের অভ্যাস হয়ে যায়,
আমাদের বয়েস হয়ে যায়,
যা যা খুঁত ছিল,
এবরো খেবরো পথ ছিল,
সবই সুমসৃণ দেখায়।

যদিও জাদুকর আছে বলে জানি,
এই যে অতল অরণ্যানি,
তার গহনে জাদুকর অপার্থিব জানি
তবু ঘুম ভেঙে যায়,
টিপটিপিয়ে উঠে পড়ি,
যদি কখনো না হয়…
যদি জীবনের কোনো বিন্দুতে ঝাপসা না হতে পারি…

Portrait of a teacher: Dr. Swadhin Pattanayak

What makes a Stony Brook graduate return to India in the 70’s and work tirelessly for decades to spread mathematics in this country? The question intrigued me since I first met Dr. Pattanayak in the summer of 2011.

Dr. Pattanayak at once struck me as an extremely familiar figure. He imbues the traits of characters from a Satyajit Ray or Ritwik Ghatak movie. His ethos is firmly rooted in the fragmented renaissance that parts of India experienced in 19th and 20th centuries. His political ideas are acutely aware of Neheruvian socialism. His engagement with vernacular literature is reminiscent of the ‘Bhadrolok’ class, his enthusiasm about the struggles of sub-altern is as intense as the Naxals of the previous century.

In fact, his internal self, seemed completely singular in the ocean of students at IoMA. The students were mostly dissociated from the rooted struggle of working people that shaped our nation or the cultural connotations of a progressive left. Yet his enthusiasm about uplifting their life and their world-view seemed unabated.

This is the defining characteristic of the work of Dr. Pattanayak. In my view, he not only tried to improve the material well being and learning of his students. Instead, much like Tagore, he was interested to build rooted citizens of the world. He was very much aware of the difficulty in achieving this objective. He personally delivered a course on Cultural History of India in IoMA. That goes on show how deeply he cared about the cultural and political formation of a student’s mind. I remember that once I requested volumes of Tagore for our library at IoMA. Dr. Pattanayak ordered the complete works of Tagore within the following week. He seemed extremely happy with the request. In the evenings of IoMA, our discussions spanned over politics, literature, mathematics and more. The more I spoke with him, I felt at home. I felt like I am in Calcutta Coffee House or in the streets of Bengal where the downtrodden would fearlessly challenge the masters.

Several years later, when I completed my Ph.D. in the United States, I acutely remembered the courage of my teacher. I remembered his mission for life, his deep concern about rooted development of citizens of the future. I returned to my homeland with renewed energy. My teacher, Professor Pattanayak, completed the circle.

প্রস্থান

যে কোনো সময় তুমি চলে যেতে পারো,
কিন্তু,
যে কোনো সময় তুমি চলে যেতে চাইতে পারো না।

সেসব কথা লিখিনা কারণ গায়ক মৃত্যু চেয়েছে,
সেসব আগাছাজীবন লেখা যায় না আমৃত্যু,
তবু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলছি,
যে কোনো সময় তুমি গটগট করে বেড়িয়ে যাও,
‘দুরছাই’ বলে বেড়িয়ে যাও,
ধ্বংস গেয়ে উঠে চলে যাও মহাপ্রস্থান।

কিন্তু ওই,
বেড়িয়ে যেতে চাইতে পারবে না।

অকাল বোধন

দেখতে দেখতে দশ বছর কেটে গেছে। এবার চতুর্থীর দিন অফিসে প্রাক-পুজো ফিস্ট ছিলো। কাননদি যথারীতি রসিয়ে রান্না করেছিলেন। কাননদি আমাদের যৌথ কিচেনের দায়িত্ত্বে আছেন। তার রান্নার হাত যতটা ভালো তত ভাল অঙ্ক কষতে পারলে আমি ফিল্ড্স পেতাম!

এই টিমটা একটা পরিবারের মত হয়ে গেছে। একজনের শরীর খারাপ হলে আরেকজন নিজে থেকে ওষুধ কিনে আনে। একজন বাইরে গেলে সে বাকিদের জিজ্ঞেস করে ‘কিছু আনতে হবে?’ মাঝে মাঝে ছোটখাট ট্রিপের পরিকল্পনা হয়। অফিসে আপাতত চা, কফি ফ্রি। সকালে, দুপুরে, বিকেলে খাওয়ার ব্যবস্থা সরকারী দামে।

এরা সবই বাংলার তরুণ তরুণী। কামাই নেই, দেরীতে ঢোকা নেই, বাজে কথায় সময় নষ্ট নেই, সারা সপ্তাহ ধরে এরা সকলেই আনন্দ করে পরিশ্রম করে। সবচেয়ে বড় কথা এরা সকলেই ভাবে কি করে তাদের কাজটা আরো সুন্দর হতে পারে। সফট্ওয়্যার ডেভেলেপমেন্ট টিমের লোকজন মাথা খাটায় কি করে আরো ভালো algorithm-এ প্রোগ্রাম করা যায়। মার্কেটিং টিমের লোকজন চিন্তা করে যে আরো সৃজনশীল ভাবে কি করে উপভোক্তার কাছে পৌঁছতে পারি। শিক্ষক চিন্তা করেন আরো ভালো করে কি পড়ানো যেতে পারে।

যারা বলেন বাঙালি কুঁড়ে, সময়ের ঠিক নেই, ফাঁকিবাজ, তাদের কারোর কথা তাই আর বিশ্বাস করি না। উপযুক্ত কাজের পরিবেশ আর ভালো কাজ করার সুযোগ থাকলে, বাঙালির সাথে কাজ করা বরং অত্যন্ত আনন্দের। কাজের ফাঁকে আলোচনা – আড্ডা অনেক বেশী মজার। তাতে রবীন্দ্রনাথ থেকে সুমন প্রায়ই উঁকি মারেন। সামান্য চায়ের ব্রেকও তাই আনন্দের।

এই অতিমারীর যুগে সেই আনন্দের অকাল বোধন হোক।

আর উপায় নেই

যা স্পষ্ট করে বলা যায় না,

শুধু সেটুকুর জন্য,

আমরা নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে পারি হাজার বছর।

যা সুবিন্যস্ত নয়,

তুখোর বা বোধবদ্ধ নয়,

যা শব্দ করে না, শব্দে বাঁচে না

তার জন্য আমরা তীব্র হয়ে থাকতে পারি হাজার মুহুর্ত।

সেই গুহার বাইরে আমি যাব,

সেই তপোবন পেরিয়ে, স্কুল বাজার উজিয়ে,

সমুদ্র ভেদ করে,

মনের দীর্ণ শালপাতা ছিন্ন করে,

আমি যাব।

আমি দেখব। আমি শুনব। আমি রোমাঞ্চিত হব।

আর তো উপায় দেখিনা।

ভেতরের ঘরে

ভেতরে দেখিনি বলে পাপ হয়েছে,

তাই ভোরবেলা উঠব ভেবেছি আজ রাতে,

শুকতারার মত যদি কেউ জ্বলে থাকে,

তাকে নেব আঁকড়ে আমি সব উজাড় করে,

এই দীর্ণ, অবচ্ছিন্ন ভেতরের ঘরে,

হঠাৎ যেন জ্যোৎস্না এসে পরে।

বন্ধক

এমন ভাবে চলে যাচ্ছে দিন,
ছুঁতে গেলে ছ্যাঁকা লেগে যায়
অর্জুনের শরসন্ধানে,
একাগ্র তার অহং তপোময়।


ফিরে দেখছি মুহুর্তের মত,
কি যেন সব লেগে থাকছে পথে,
অবিরত ধুলার মত তার,
মৃত্যু হয়। হয়েও হয় না।

এক মুঠো জুঁই ফুলের কাছে,
আমার সব জাহাজ বাঁধা আছে,
সমস্ত দিনই সফল হয়,
শুধু তার গন্ধ মেটে না।

কৌতুহল

মোহ লেগে থাকে। হয়ত থেকে যাব অক্ষয় বটের মত। হয় না। তবু কৌতুহল থাকে বই কি। কেমন হত দেখা হয়ে গেলে? শ্রমসিক্ত দিনের শেষে তার হাসি দেখলে? কেমন হত বলত?

হাঁটতে হাঁটতে কাফের প্রান্তে দাঁড়াই। একতলা গুলো সুন্দর করে সাজানো। কিছু পয়সা পেয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালি। সেই বেশি বয়সের কন্যাও কিছু অবসর পেয়েছে। এত দিন পর! সেই পয়সা দিয়ে একটা দুটো ঘর সাজানো যাক। কলকাতার বুকে নেমে আসুক এক টুকরো পারি, বেলজিয়াম বা বোলপুর।

সে কন্যা কাঁচা পাকা চুল গুছিয়ে বাড়ি ফিরবে রাত হলে। মা’র আজ ওষুধ গুলো বাকি। প্লাম্বারকে ডাকতে হবে।

আজ অবধি দিনলিপি লিখিনি। জমাতে ইচ্ছাই করে না। বরং ছুটোছুটি করতে ইচ্ছা করে। সেই প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের প্রান্তে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে। কি অসীম সম্ভাবনা আছে জীবনে। দেখা হওয়ার অবিশ্বাস্য সম্ভাবনা। তাই নিয়ে স্পষ্ট করে বলতে ইচ্ছা করে।

বাঙালি তেমন কোন স্পষ্ট ছবি আঁকেনি। ঘোলাটে রং-এ, মামুলি কথনে তার যত অনুরাগ। সে জার্মানদের মত সুনিশ্চিত নয়। সে ব্রিটিশদের মত দুনিয়াদারও নয়। মারোয়ারীদের মত পা টিপে টিপে চলা তার ধাতে নেই। আমারও তাই বাঙালিদের মত হতে ইচ্ছা করে। মাঝে, মাঝে।

কেমন হত দেখা হলে? সেই অসহ্য ত্রহ্যস্পর্শ যার সম্ভাবনা টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে আছে জীবনভোর। যার জন্য মন আর থামছে না কোনো বহুতলে। কৌতুহল বুঝি থেকে গেল আজন্মের মত।

সেমন্তি ঘোষ – প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের কাজের প্রতিবাদ মানেই দেশদ্রোহ? (আনন্দবাজার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)

জেএনইউ-র প্রাক্তন ছাত্র উমর খালিদ নিজে আন্দোলন করেছেন এত কাল, এখন তাঁকে নিয়ে কোনও আন্দোলন হবে কি? যদিও করোনাকালে আন্দোলন মানে সমাজমাধ্যমে ‘উমর খালিদ, সঙ্গে আছি’, এইটুকুই। দিল্লিতে অবশ্য একটা প্রেস কনফারেন্স হয়েছে। দিল্লি নৃশংসতার (দাঙ্গা নয়, দাঙ্গা বলে দ্বিপাক্ষিক হিংসাকে) সময় শহরে উপস্থিত না-থাকা সত্ত্বেও তার দায়ে উমর খালিদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ (আনল’ফুল অ্যাকটিভিটিজ় প্রিভেনশন অ্যাক্ট) দিয়ে ভয়ঙ্কর অভিযোগ আনতে দেখে স্তম্ভিত যাঁরা, তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে সেখানে। প্রশান্ত ভূষণ এই চার্জশিটকে বলেছেন ‘ক্রিমিনাল কনস্পিরেসি’। কানহাইয়া কুমার-সহ অনেকেই জানতে চেয়েছেন, কোথায় সেই বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর বা কপিল মিশ্রদের নাম, যাঁরা খোলাখুলি দিল্লি নৃশংসতায় উসকানি দিচ্ছিলেন? প্রতিহিংসা ছাড়া সম্ভবত এই চার্জশিটের কোনও ব্যাখ্যা নেই। দিল্লি নৃশংসতায় যাঁরা প্রকাশ্যেই হিংসাত্মক উসকানি দিয়েছেন, তাঁদের বদলে চার্জশিটে দেখা যাচ্ছে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদীদের নাম।

এরই মধ্যে অভূতপূর্ব কাণ্ড। নয় জন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার দিল্লি পুলিশ কমিশনার শ্রীবাস্তবকে খোলা চিঠি লিখলেন‌ যে, এই চার্জশিটের মধ্যে ন্যায্য তদন্তের ছায়াও নেই! লিখলেন, ‘‘ভারতীয় পুলিশের ইতিহাসে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যময় দিন আজ।’’ ‘‘এ ভাবে ‘সংখ্যাগুরুবাদের মনোভাব’ নিয়ে ন্যায়বিচারের নামে চূড়ান্ত অন্যায় ঘটল— ‘ট্র্যাভেস্টি অব জাস্টিস’! বোঝাই যাচ্ছে যারা আসল অপরাধী তারা সহজেই ছাড়া পেয়ে যাবে।’’ প্রসঙ্গত, এই সিনিয়র অফিসাররা কেউই ঠিক কুড়িয়ে-বাড়িয়ে আনা কণ্ঠ নন, সকলেই ‘কনস্টিটিউশনাল কনডাক্ট গ্রুপ’-এর সদস্য। এর প্রধান— পদ্মভূষণ প্রাপ্ত জুলিয়ো ফ্রান্সিস রিবেইরো, এক কালের মুম্বই পুলিশ কমিশনার, ডিজিপি পঞ্জাব ও ডিজিপি গুজরাত, তাঁর মতে— ‘‘যে সব কথা বিজেপি নেতারা বলেছেন, কোনও মুসলিম বা বামপন্থী তা বললে অবশ্যই তাঁকে দেশদ্রোহের অভিযোগে জেলে পোরা হত।’’ তিনি জানতে চেয়েছেন, মনে আছে তো দিল্লি পুলিশকর্তাদের, পুলিশের কাজে যোগ দেওয়ার সময় কী শপথ নিয়েছিলেন তাঁরা? 

অতীব কড়া বার্তা। এর আগে বিচারবিভাগের ভিতর থেকে উঠে আসা আত্ম-ভর্ৎসনা শুনেছি আমরা, এ বার শুনছি পুলিশের ভিতর থেকে। আশা করতে ইচ্ছে করে, উমর খালিদকে নিয়ে অন্তত আরও ক’টা দিন এই সব কথা চলবে। নাগরিক নীরবতা ও বিস্মৃতির বিভ্রমে তলিয়ে যাওয়ার আগে আর একটু তোলপাড় হবে!  

‘আশা’ই। কেননা, হয়তো উমর খালিদের সূত্রে আরও অনেকের কথা উঠে আসবে আমাদের বিভ্রান্ত মানসপটে। সেই অন্যরা, যাঁদের নাম গত কয়েক মাসে অস্বাভাবিক ঘটনা-আবর্তের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। যেমন, ছাব্বিশ বছরের তরুণী কাশ্মীরি চিত্র-সাংবাদিক মাসরাত জ়াহরা। সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ভাবে ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত হন তিনি। যেমন, দ্য হিন্দু পত্রিকার রিপোর্টার পিরজ়াদা আশিক, ধরা পড়েন ইউএপিএ-তে, কাশ্মীরের খবর ‘কভার’ করে!

কিংবা, সিএএ-প্রতিবাদী কলেজপড়ুয়া সাফুরা জ়ারগার, মিরান হায়দর, শারজিল ইমাম। এঁদেরও সম্প্রতি ধরা হয়েছে ইউএপিএ ধারায়। নামগুলো শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনলে এক বিরাট অংশের মানুষ এক কথায় তা বিশ্বাস করবেন। আর যাঁরা বিশ্বাস করার আগে তথ্যপ্রমাণ চাইবেন, তাঁরা এই করোনা-আবহে হারিয়ে যেতে বসেছেন! অবশ্য তথ্যপ্রমাণ চাইলেই বা কী। প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখা এবং দলিত-মার্ক্সবাদী লেখক-সমাজকর্মী আনন্দ তেলতুম্বডের কথা তো শুনছি কত বারই— তেমন প্রমাণ ছাড়াই যাঁরা দেশদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত। ‘পদ্মশ্রী’-ভূষিত সাংবাদিক বিনোদ দুয়ার বিরুদ্ধেও ১২৪-এ ধারার (দেশদ্রোহিতা) অভিযোগ। কেন দেশদ্রোহ? দুয়া বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের কোভিড-ম্যানেজমেন্ট খুব খারাপ। সিধে হিসেব, সোজা রাস্তা।

হিসেবটা সত্যিই সিধে। মোদী মানেই দেশ, তাঁর সমালোচনা মানেই দেশের সমালোচনা, আর দেশের সমালোচনা মানেই দেশের প্রতি দ্রোহ কিংবা সন্ত্রাস। (অবশ্যই মনে রাখব আমরা, সব প্রধানমন্ত্রী মানেই ‘দেশ’ নয়, ‘দেশ’ কেবল এক জনই। তাই মনমোহন সিংহের নামে বাঁকা কথা চলতেই পারে, নেহরু বা ইন্দিরা তো সত্তর বছরের সব দুর্দৈবের জন্যই দায়ী!) 

কিসে দেশের মুখ নিচু হয়, কিসে দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ঘোষণা করা হয়— ইউএপিএ কিংবা এনএসএ-র মতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের সাম্প্রতিক প্রয়োগই বুঝিয়ে দেয়। এই যেমন, জাতীয় নিরাপত্তা আইনে ৬ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের বাহরাইচে এক জন গ্রেফতার হলেন। সন্দেহ: তিনি নাকি গরু হত্যায় জড়িত। এই প্রসঙ্গে সামনে এল ভারী চমকপ্রদ তথ্য: এ বছর উত্তরপ্রদেশে এনএসএ-তে যে ১৩৯ জনকে ধরা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৭৬ জনই গোহত্যার অভিযোগে ধৃত! গরু যে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে গভীর ও মৌলিক ভাবে যুক্ত, সেটা এতই সহজ কথা যে, এ নিয়ে বিশেষ কেউ মাথাও ঘামাননি, সমাজমাধ্যম-সংবাদমাধ্যমে ঝড়ও বয়ে যায়নি! 

এই সবই ঘটছে করোনা-কালের ভারতে। এখন মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, চাকরি বাঁচাতে উদ্বিগ্ন। এই সব সময়ে চেঁচামেচি করতে কাঁহাতক ইচ্ছে করে! সংসদের ক্লাসেও আজকাল প্রশ্ন করা বারণ, মন্ত্রীদেরও স্পিকার মশাই কথা বলতে দেন না, বিরোধীরা কোন ছার। সংসদের বাইরে বিরোধী নেতানেত্রীরা যেটুকু হাঁকডাক পাড়েন, সে সব ‘এমনিই এসে ভেসে যায়’। এমতাবস্থায় ছাত্র-সাংবাদিক-সমাজকর্মী গরু-খাদক গরু-বিক্রেতাদের জামিন-বিহীন জেলে পুরলে অনেক দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। তা ছাড়া যাঁদের ধরা হচ্ছে না, তাঁদেরও পষ্টাপষ্টি বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে— ভয়ের ফাঁদ পাতা ভুবনে! গরুর সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা জুড়ে ঠিক এটাই জানাতে চান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। একের পর এক সিএএ-বিরোধী নেতাকে চার্জশিট দিয়েও এটাই বলতে চান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।   

ভয় যদি তুরুপের তাস হয়, খুবই কাজের জিনিস ইউএপিএ, সন্দেহ নেই। তাই দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা পেয়েই এই আইনের পরিসর অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন মোদী, যাতে নানা রকম ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা যায়। ইউএপিএ সংশোধনী বিল এসেছিল ২০১৯ সালের অগস্টে। মনে পড়ে, তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র জোরদার প্রতিবাদ করেছিলেন। এনডিএ-র বিরাট সংখ্যার জোয়ার কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই প্রতিবাদ! 

দুটো নতুন কথা যোগ হয় সংশোধনীতে। এক নম্বর, যে সব কেস রাজ্য সরকারের পুলিশের এক্তিয়ারে পড়ে, সেখানেও ‘প্রয়োজনবোধে’ এনআইএ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) প্রধান ভূমিকা পালন করবে। দুই নম্বর— যেটা গণতন্ত্রের পক্ষে আরও বেশি মারাত্মক— শুধু গোষ্ঠী বা সংস্থা নয়, যে কোনও একক ‘ব্যক্তি’কেও এ বার সন্ত্রাসবাদী বলে অভিযুক্ত করা যাবে। লোকসভায় অমিত শাহ একটি অসাধারণ বৃত্তাকার যুক্তি দিলেন— সন্ত্রাসবাদী ধরার এই ব্যবস্থায় আপত্তি করতে পারে কেবল সন্ত্রাসবাদীরাই। অর্থাৎ এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ=আপত্তি=সন্ত্রাস, সুতরাং তাকে ধরার জন্য এই আইন। নিপাট বৃত্ত যাকে বলে।

সংশোধনীতে রইল আরও একটা কথা। কেউ যদি কোনও ভাবে সন্ত্রাসকে পোষণ করে কিংবা সাহায্য করে, সে তবে সন্ত্রাসবাদী: ‘হু হেলপস প্রোমোট অর প্রিপেয়ার ফর টেররিজ়ম’। মানেটা বোঝা দরকার। আসলে, কোথায় যে বাক্‌স্বাধীনতার শেষ, কোনটা সরকার বা রাষ্ট্রের বিরোধিতা, আর কোনটা বিচ্ছিন্নতাবাদ বা দেশদ্রোহ, এ সবের মধ্যেকার সীমারেখা নিয়ে দেশে বিদেশে, পুরনো নতুন গণতন্ত্রে, আমেরিকায় ব্রিটেনে ভারতে তর্কবিতর্ক প্রচুর, গভীর, ব্যাপক, জটিল। তারই মধ্যে ২০১৫ সালের মার্চে (মোদীর শাসনকালের গোড়াতেই) ‘শ্রেয়া সিঙ্ঘল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ ঠিক এমনই একটা ‘প্রতিবাদ না কি সন্ত্রাস’ মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক যুগান্তকারী রায় দেয়। বলা হয়, বাক্‌স্বাধীনতার মধ্যে তিনটে ধারণা: আলোচনা (ডিসকাশন), পরামর্শ (অ্যাডভোকেসি) এবং উসকানি (ইনসাইটমেন্ট)—শেষটি ছাড়া কোনও কিছুই ১৯(২) ধারার আওতায় ফেলে পাবলিক অর্ডার ভঙ্গ করার অভিযোগ আনা যাবে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ— ইনসাইটমেন্ট বা উসকানি সুদূর বা পরোক্ষ হলেও সেটা অপরাধ বলে ধরা যাবে না। কারও কথা বা কাজ হিংসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত হলেই (বারুদের মধ্যে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ফেলার মতো) কেবল তাকে এই ধারায় ফেলা যাবে। 

এই ১৯(২) ধারার সঙ্গেই ইউএপিএ যুক্ত, তাই এই ইতিহাসটা এখানে অত্যন্ত জরুরি। একটি বহুসংস্কৃতির দেশে, গণতন্ত্রের দেশে, সর্বোচ্চ আদালতের ওই দিগদর্শনটি ছিল স্পষ্ট, ঋজু আর বিবেচনাসম্পন্ন। ২০১৯ সালের ইউএপিএ সংশোধনীর মাধ্যমে মোদী-শাহ সুপ্রিম কোর্টের এই দিগদর্শনকেই বরবাদ করেছিলেন। তার পর থেকে নতুন দেশদ্রোহ ধারায় চলছে মোদীজির নতুন দেশ।        

করোনা চলছে। চলছে ইউএপিএ-ও। ভারত আমার ভারতবর্ষ, মৃত্যুসন্তপ্ত রোগসন্ত্রস্ত বিভ্রান্ত বিপর্যস্ত। বিপর্যয় তো কেবল রোগে নয়, তার আড়াল দিয়ে লুকিয়ে চলা আরও অনেক কিছুতেই। দিল্লি চার্জশিটের সূত্রে সে সব কি মনে পড়ল কিছুটা? সামান্য উসখুসও কি হল কোথাও?