ভোর চারটের সময় সন্ধি পুজো। কান খাড়া করে আমি শুয়ে। পাশেই মা ঘুমে অচৈতন্য। ঠিক সাড়ে তিনটের সময় ডাক, ‘অনি, উঠেছিস?’ সন্ধি পুজার পদ্মফুল বাছা হবে। একশো আট পদ্ম। মেয়েটা তাই আমায় ডাকতে এসেছে। একা একা অতগুলো ফুল কি বাছা যায়?
ঘুম নেই
এখন রাত বারোটা চল্লিশ। ঘুমে চোখ বুজে আসছে। তবু লেখার মোহ কাটাতে পারছি না। এ যেন পুজোর রাত গুলোর মত। ঘুম আছে কিন্তু ঘুম নেই।
কেন্সিংটন উদ্যানে
বঙ্গবাসী
দুবাই এয়ারপোর্ট জমজমাট জায়গা। অনেকটা শিকাগোর মত। সাড়ে বত্রিশ ভাজা জনতা হন্ত দন্ত হয়ে হেঁটে চলেছে। লাউঞ্জের একটা বৃহৎ অংশ জুড়ে বিপণি। যে কটা এয়ারপোর্টে আজ অবধি গেছি, সর্বত্রই দোকানপত্র একই ধাঁচের। মার্কিণ আর ইউরোপীয় বহুজাতিকের বিনোদন এবং প্রসাধন সামগ্রীর ছড়াছড়ি। অতএব কোলকাতা অথবা মুম্বাইএর বড় মাপের শপিং মলে গেলে যা দেখা যায়, এখানেও সেই চিত্র। শিকাগোর মতই দুবাই এয়ারপোর্টের ভেতরে ট্রেনের ব্যবস্থা আছে; এক অংশ থেকে অন্য অংশে যাওয়ার জন্য। আমাকে এ ১২ থেকে প্লেন ধরতে হবে। ট্রেনে করে যাওয়ার পথে একটা কৃত্রিম প্রস্রবন পড়ল। মনে আছে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন শহরে এমন দেখেছিলাম। সে অবশ্য এয়ারপোর্টে নয়।
ভারতীয় জনতার ঢল নেমেছে এয়ারপোর্টে। যে ট্রেন ধরে লণ্ডনের ফ্লাইট ধরতে গেলাম, তার প্রায় আট আনা যাত্রী ভারতীয়। চেক ইন করার পরে লাউঞ্জে বসেছি। এমন সময় পিছন থেকে বিরক্ত কণ্ঠস্বর, ‘পাপান কই গেল।’ স্বামী মহাশয় যথাশক্তি কাঁচুমাচু হলেন ‘আরে ধরতে গেলাম, ছুটে পেছনের দিকে চলে গেল।’ গৃহিনী চোখ দিয়ে অগ্নি বর্ষালেন। অতএব পাপান সংগ্রহ পর্ব প্রারম্ভ। তা আমাদের জোড়াসাঁকোর গলি হোক বা দুবাইএর বিমানবন্দর, ‘সব এক একই’।
দুবাই থেকে লণ্ডন পৌঁছতে বোধহয় ঘণ্টা আটেক সময় লাগে। আমি তো ইকোনমি ক্লাসে ডিমোটেড হয়ে গেছি। না যাচ্ছে হাত পা ছড়ানো, না আছে খাবারে সেই আরাম। যাই হোক তবু বলতে হবে এমিরেটস খুব ভাল এয়ারলাইন। লুফতহানসা অথবা এমেরিক্যান এয়ারলাইন্সের থেকে অনেক ভাল।
গ্যাটউইকে নামালো সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়। কি আশ্চর্য্য। বাইরে এখনো যে আলো আছে! ইমিগ্রেশন, ব্যাগেজ ইত্যাদীর ঝামেলা চুকিয়ে গ্যাটউইক এক্সপ্রেসের স্টেশনের দিকে যাব। বহুকাল আগে ব্রিটেন দিয়ে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার পথে হিথরো তে দাঁড়াতে হয়ে ছিল। এয়ারপোর্টটাকেই খুব মরা মরা লেগেছিল সেবার। গম্ভির মুখে লোকজন গটমট করে হেঁটে যাচ্ছে। গ্যাটউইক অন্যরকম নয়। অবশ্য লণ্ডনে ঢোকার পর আমার অভিজ্ঞতা এখনো অবধি অন্যরকম। সে প্রসঙ্গে আসছি।
যারা লণ্ডন যাবেন বলে ভাবছেন, মাথায় রাখুন যথা সম্ভব কেনাকাটা (ট্রেনের টিকিট ইত্যাদী) অনলাইন করে আসাই ভাল। এতে লাইনে দাঁড়াতে হয় না আর বেশ খানিক টাকাও বাঁচে। আমি দেশ থেকে আসার আগেই গ্যাটউইক এক্সপ্রেসের টিকিট কেটে রেখেছিলাম। রিটার্ন টিকিট (এক মাসের মধ্যে ফেরত- যাত্রা করতে হবে)। টিকিট প্রায় ৩২ পাউণ্ড (৩২০০ টাকা)। মাত্র আধ ঘণ্টা সময় নেয়। লণ্ডন ভিক্টোরিয়া স্টেশনে নামিয়ে দেবে। একটা বাস সার্ভিস আছে, যাতে গ্যাটউইক থেকে লণ্ডন একটু সস্তায় আসা যায়। কিন্তু সে সার্ভিসের অবস্থা শুনেছি খুবই খারাপ। ছোট ছোট বাস, বসার জায়গা পাওয়া যায় না (রিজার্ভেশন থাকলেও)। মোদ্যা কথা খরচ একটু বেশি হলেও ট্রেনে যাওয়া ভাল।
গ্যাটউইক এয়ারপোর্ট থেকে গ্যাটউইক স্টেশনে যেতে মিনিট দশেক লাগে। একটা শাটলের ব্যাবস্থা আছে। এয়ারপোর্টের ভেতরে চিহ্ন দেখে দেখে শাটল অবধি পৌঁছে গেলাম। কয়েকটা ছেলে সাইকেল নিয়ে শাটলে ঢুকে পড়ল। মিনিট তিনেক পরেই ট্রেন স্টেশন। ই টিকিট ছিল। সেটা থেকে এমনি টিকিট বানিয়ে গ্যাটউইক এক্সপ্রেসে ঢুকে পড়লাম। রেডহিল, ইস্ট ক্রয়ডন আর ক্ল্যাপহ্যাম পেরিয়ে লণ্ডন ভিক্টোরিয়া। আমি কলকাতার ভিসা অফিস থেকেই অয়েস্টার কার্ড কিনে নিয়ে ছিলাম। ২৪০০ টাকা খরচ। কিন্তু খুব খুব কাজের বস্তু। ট্রেন, বাস অথবা টিউবের টিকিট লাইনে দাঁড়াতে হবেনা, টিকিটের দামও অনেক কম পড়ে। একদম আমাদের মেট্রোর স্মার্টকার্ডের মত।
আমি বেসওয়াটারে, হাইড পার্ক ইন নামে একটা ইউথ হোস্টেলে বুকিং করেছি। লণ্ডন ভিক্টোরিয়া থেকে বেসওয়াটার অবধি পৌঁছতে হল টিউবে করে। আমাদের মেট্রো রেলের মত। তবে চেহারা বেশ ভাল। এমনকি দিল্লীর মেট্রোর থেকেও ভাল। আমি টিউবে উঠে বোঝার চেষ্টা করছি কোথায় নামব, এমন সময় একটি মেয়ে আমায় ডাকল। ‘জানো কোথায় নামতে হবে?’ আমি একটু অপ্রস্তুত হেসে বললাম, বেসওয়াটার যেতে হলে, হলুদ বৃত্তের টিউবে উঠতে হয় এতটুকুই জানি। ‘তোমায় আর্লস কোর্টে নেমে ট্রেন বদলাতে হবে।’ মেয়েটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমায় বুঝিয়ে দিল ঠিক কোথায় কিভাবে ট্রেন পালটাবো, কোন প্ল্যাটফর্মে ট্রেন পাবো। আমি একটু অবাকই হলাম। বৃটিশদের তো নাক উঁচু, উন্নাসিক বলেই শুনেছি। আর্লস কোর্টে নেমে ট্রেন পালটালাম। এক ভদ্রলোক, তিনিও বোধহয় নতুন, এগিয়ে এলেন, ‘আচ্ছা, এই ট্রেন প্যাডিংটন যাবে?’ আমি কলকাতার মানুষ। রাস্তা জিজ্ঞেস করলে ঠিকানা বাতলে দেওয়ার অভ্যাস। মুখচুন করে বললাম, ‘আমিও নতুন।’ ইতিমধ্যে এক ইংরেজ তরুণ আমাদের কথা শুনছিলেন। তিনি নিজের থেকেই আমাদের সাহায্য করলেন, ‘ট্রেন পালটাতে হবে আপনাদের। এটা হাই কেন্সিনঙ্গটন অবধি যাবে।’ অমরেন্দ্র চক্রবর্তীর ভ্রমণ কাহিনীতে পড়েছি, যে কোনও দেশেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্ধু পাওয়া যায়। সহৃদয় মানুষ পাওয়া যায়। নাক উঁচু মানুষ কোথায় নেই? সব দেশে সব কালেই আছে। কিন্তু উলটো ছবিও বেমিল নয়।
বঙ্গবাসী কলেজের পাশে ‘আহার’ এক প্রখ্যাত ভাতের হোটেল। সেখান থেকে দু’পা হাঁটলেই সূর্য্য সেন সরণী। ফেভারিট কেবিন, রমানাথের চায়ের দোকান। বঙ্গ-বাসী অথবা কলকাতা-বাসি হওয়ার অনেক মন খারাপ হওয়া দিক আছে। কিন্তু ‘দাদা রজনী সেন রোড টা কোন দিকে?’ প্রশ্ন এলে, আমরা ফেলুদার দুয়ার অবধি দেখিয়ে আসি। এ ব্যাপারটা কিন্তু ফেলে দেবার মত নয়।
London
ছবি
মৈনুদ্দীন
কলকাতা এয়ারপোর্ট অনেক পালটে গেছে। ২০০৮ সালে শিকাগো – দিল্লী হয়ে কলকাতার আকশে যখন ফিরেছি, এয়ারপোর্ট দেখে মনে হয়েছে যেন বাংলার গ্রাম। ২০১৪ তে গ্রাম আর গ্রাম নেই। শহর হয়ে উঠেছে।