সেমন্তি ঘোষ – প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের কাজের প্রতিবাদ মানেই দেশদ্রোহ? (আনন্দবাজার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)

জেএনইউ-র প্রাক্তন ছাত্র উমর খালিদ নিজে আন্দোলন করেছেন এত কাল, এখন তাঁকে নিয়ে কোনও আন্দোলন হবে কি? যদিও করোনাকালে আন্দোলন মানে সমাজমাধ্যমে ‘উমর খালিদ, সঙ্গে আছি’, এইটুকুই। দিল্লিতে অবশ্য একটা প্রেস কনফারেন্স হয়েছে। দিল্লি নৃশংসতার (দাঙ্গা নয়, দাঙ্গা বলে দ্বিপাক্ষিক হিংসাকে) সময় শহরে উপস্থিত না-থাকা সত্ত্বেও তার দায়ে উমর খালিদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ (আনল’ফুল অ্যাকটিভিটিজ় প্রিভেনশন অ্যাক্ট) দিয়ে ভয়ঙ্কর অভিযোগ আনতে দেখে স্তম্ভিত যাঁরা, তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে সেখানে। প্রশান্ত ভূষণ এই চার্জশিটকে বলেছেন ‘ক্রিমিনাল কনস্পিরেসি’। কানহাইয়া কুমার-সহ অনেকেই জানতে চেয়েছেন, কোথায় সেই বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর বা কপিল মিশ্রদের নাম, যাঁরা খোলাখুলি দিল্লি নৃশংসতায় উসকানি দিচ্ছিলেন? প্রতিহিংসা ছাড়া সম্ভবত এই চার্জশিটের কোনও ব্যাখ্যা নেই। দিল্লি নৃশংসতায় যাঁরা প্রকাশ্যেই হিংসাত্মক উসকানি দিয়েছেন, তাঁদের বদলে চার্জশিটে দেখা যাচ্ছে সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদীদের নাম।

এরই মধ্যে অভূতপূর্ব কাণ্ড। নয় জন প্রাক্তন আইপিএস অফিসার দিল্লি পুলিশ কমিশনার শ্রীবাস্তবকে খোলা চিঠি লিখলেন‌ যে, এই চার্জশিটের মধ্যে ন্যায্য তদন্তের ছায়াও নেই! লিখলেন, ‘‘ভারতীয় পুলিশের ইতিহাসে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যময় দিন আজ।’’ ‘‘এ ভাবে ‘সংখ্যাগুরুবাদের মনোভাব’ নিয়ে ন্যায়বিচারের নামে চূড়ান্ত অন্যায় ঘটল— ‘ট্র্যাভেস্টি অব জাস্টিস’! বোঝাই যাচ্ছে যারা আসল অপরাধী তারা সহজেই ছাড়া পেয়ে যাবে।’’ প্রসঙ্গত, এই সিনিয়র অফিসাররা কেউই ঠিক কুড়িয়ে-বাড়িয়ে আনা কণ্ঠ নন, সকলেই ‘কনস্টিটিউশনাল কনডাক্ট গ্রুপ’-এর সদস্য। এর প্রধান— পদ্মভূষণ প্রাপ্ত জুলিয়ো ফ্রান্সিস রিবেইরো, এক কালের মুম্বই পুলিশ কমিশনার, ডিজিপি পঞ্জাব ও ডিজিপি গুজরাত, তাঁর মতে— ‘‘যে সব কথা বিজেপি নেতারা বলেছেন, কোনও মুসলিম বা বামপন্থী তা বললে অবশ্যই তাঁকে দেশদ্রোহের অভিযোগে জেলে পোরা হত।’’ তিনি জানতে চেয়েছেন, মনে আছে তো দিল্লি পুলিশকর্তাদের, পুলিশের কাজে যোগ দেওয়ার সময় কী শপথ নিয়েছিলেন তাঁরা? 

অতীব কড়া বার্তা। এর আগে বিচারবিভাগের ভিতর থেকে উঠে আসা আত্ম-ভর্ৎসনা শুনেছি আমরা, এ বার শুনছি পুলিশের ভিতর থেকে। আশা করতে ইচ্ছে করে, উমর খালিদকে নিয়ে অন্তত আরও ক’টা দিন এই সব কথা চলবে। নাগরিক নীরবতা ও বিস্মৃতির বিভ্রমে তলিয়ে যাওয়ার আগে আর একটু তোলপাড় হবে!  

‘আশা’ই। কেননা, হয়তো উমর খালিদের সূত্রে আরও অনেকের কথা উঠে আসবে আমাদের বিভ্রান্ত মানসপটে। সেই অন্যরা, যাঁদের নাম গত কয়েক মাসে অস্বাভাবিক ঘটনা-আবর্তের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে। যেমন, ছাব্বিশ বছরের তরুণী কাশ্মীরি চিত্র-সাংবাদিক মাসরাত জ়াহরা। সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ভাবে ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত হন তিনি। যেমন, দ্য হিন্দু পত্রিকার রিপোর্টার পিরজ়াদা আশিক, ধরা পড়েন ইউএপিএ-তে, কাশ্মীরের খবর ‘কভার’ করে!

কিংবা, সিএএ-প্রতিবাদী কলেজপড়ুয়া সাফুরা জ়ারগার, মিরান হায়দর, শারজিল ইমাম। এঁদেরও সম্প্রতি ধরা হয়েছে ইউএপিএ ধারায়। নামগুলো শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনলে এক বিরাট অংশের মানুষ এক কথায় তা বিশ্বাস করবেন। আর যাঁরা বিশ্বাস করার আগে তথ্যপ্রমাণ চাইবেন, তাঁরা এই করোনা-আবহে হারিয়ে যেতে বসেছেন! অবশ্য তথ্যপ্রমাণ চাইলেই বা কী। প্রখ্যাত মানবাধিকার কর্মী গৌতম নওলাখা এবং দলিত-মার্ক্সবাদী লেখক-সমাজকর্মী আনন্দ তেলতুম্বডের কথা তো শুনছি কত বারই— তেমন প্রমাণ ছাড়াই যাঁরা দেশদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত। ‘পদ্মশ্রী’-ভূষিত সাংবাদিক বিনোদ দুয়ার বিরুদ্ধেও ১২৪-এ ধারার (দেশদ্রোহিতা) অভিযোগ। কেন দেশদ্রোহ? দুয়া বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের কোভিড-ম্যানেজমেন্ট খুব খারাপ। সিধে হিসেব, সোজা রাস্তা।

হিসেবটা সত্যিই সিধে। মোদী মানেই দেশ, তাঁর সমালোচনা মানেই দেশের সমালোচনা, আর দেশের সমালোচনা মানেই দেশের প্রতি দ্রোহ কিংবা সন্ত্রাস। (অবশ্যই মনে রাখব আমরা, সব প্রধানমন্ত্রী মানেই ‘দেশ’ নয়, ‘দেশ’ কেবল এক জনই। তাই মনমোহন সিংহের নামে বাঁকা কথা চলতেই পারে, নেহরু বা ইন্দিরা তো সত্তর বছরের সব দুর্দৈবের জন্যই দায়ী!) 

কিসে দেশের মুখ নিচু হয়, কিসে দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ঘোষণা করা হয়— ইউএপিএ কিংবা এনএসএ-র মতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা আইনের সাম্প্রতিক প্রয়োগই বুঝিয়ে দেয়। এই যেমন, জাতীয় নিরাপত্তা আইনে ৬ সেপ্টেম্বর উত্তরপ্রদেশের বাহরাইচে এক জন গ্রেফতার হলেন। সন্দেহ: তিনি নাকি গরু হত্যায় জড়িত। এই প্রসঙ্গে সামনে এল ভারী চমকপ্রদ তথ্য: এ বছর উত্তরপ্রদেশে এনএসএ-তে যে ১৩৯ জনকে ধরা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৭৬ জনই গোহত্যার অভিযোগে ধৃত! গরু যে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে গভীর ও মৌলিক ভাবে যুক্ত, সেটা এতই সহজ কথা যে, এ নিয়ে বিশেষ কেউ মাথাও ঘামাননি, সমাজমাধ্যম-সংবাদমাধ্যমে ঝড়ও বয়ে যায়নি! 

এই সবই ঘটছে করোনা-কালের ভারতে। এখন মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত, চাকরি বাঁচাতে উদ্বিগ্ন। এই সব সময়ে চেঁচামেচি করতে কাঁহাতক ইচ্ছে করে! সংসদের ক্লাসেও আজকাল প্রশ্ন করা বারণ, মন্ত্রীদেরও স্পিকার মশাই কথা বলতে দেন না, বিরোধীরা কোন ছার। সংসদের বাইরে বিরোধী নেতানেত্রীরা যেটুকু হাঁকডাক পাড়েন, সে সব ‘এমনিই এসে ভেসে যায়’। এমতাবস্থায় ছাত্র-সাংবাদিক-সমাজকর্মী গরু-খাদক গরু-বিক্রেতাদের জামিন-বিহীন জেলে পুরলে অনেক দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। তা ছাড়া যাঁদের ধরা হচ্ছে না, তাঁদেরও পষ্টাপষ্টি বুঝিয়ে দেওয়া যাচ্ছে— ভয়ের ফাঁদ পাতা ভুবনে! গরুর সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা জুড়ে ঠিক এটাই জানাতে চান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। একের পর এক সিএএ-বিরোধী নেতাকে চার্জশিট দিয়েও এটাই বলতে চান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।   

ভয় যদি তুরুপের তাস হয়, খুবই কাজের জিনিস ইউএপিএ, সন্দেহ নেই। তাই দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা পেয়েই এই আইনের পরিসর অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছিলেন মোদী, যাতে নানা রকম ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা যায়। ইউএপিএ সংশোধনী বিল এসেছিল ২০১৯ সালের অগস্টে। মনে পড়ে, তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ মহুয়া মৈত্র জোরদার প্রতিবাদ করেছিলেন। এনডিএ-র বিরাট সংখ্যার জোয়ার কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই প্রতিবাদ! 

দুটো নতুন কথা যোগ হয় সংশোধনীতে। এক নম্বর, যে সব কেস রাজ্য সরকারের পুলিশের এক্তিয়ারে পড়ে, সেখানেও ‘প্রয়োজনবোধে’ এনআইএ (ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) প্রধান ভূমিকা পালন করবে। দুই নম্বর— যেটা গণতন্ত্রের পক্ষে আরও বেশি মারাত্মক— শুধু গোষ্ঠী বা সংস্থা নয়, যে কোনও একক ‘ব্যক্তি’কেও এ বার সন্ত্রাসবাদী বলে অভিযুক্ত করা যাবে। লোকসভায় অমিত শাহ একটি অসাধারণ বৃত্তাকার যুক্তি দিলেন— সন্ত্রাসবাদী ধরার এই ব্যবস্থায় আপত্তি করতে পারে কেবল সন্ত্রাসবাদীরাই। অর্থাৎ এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ=আপত্তি=সন্ত্রাস, সুতরাং তাকে ধরার জন্য এই আইন। নিপাট বৃত্ত যাকে বলে।

সংশোধনীতে রইল আরও একটা কথা। কেউ যদি কোনও ভাবে সন্ত্রাসকে পোষণ করে কিংবা সাহায্য করে, সে তবে সন্ত্রাসবাদী: ‘হু হেলপস প্রোমোট অর প্রিপেয়ার ফর টেররিজ়ম’। মানেটা বোঝা দরকার। আসলে, কোথায় যে বাক্‌স্বাধীনতার শেষ, কোনটা সরকার বা রাষ্ট্রের বিরোধিতা, আর কোনটা বিচ্ছিন্নতাবাদ বা দেশদ্রোহ, এ সবের মধ্যেকার সীমারেখা নিয়ে দেশে বিদেশে, পুরনো নতুন গণতন্ত্রে, আমেরিকায় ব্রিটেনে ভারতে তর্কবিতর্ক প্রচুর, গভীর, ব্যাপক, জটিল। তারই মধ্যে ২০১৫ সালের মার্চে (মোদীর শাসনকালের গোড়াতেই) ‘শ্রেয়া সিঙ্ঘল বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ ঠিক এমনই একটা ‘প্রতিবাদ না কি সন্ত্রাস’ মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক যুগান্তকারী রায় দেয়। বলা হয়, বাক্‌স্বাধীনতার মধ্যে তিনটে ধারণা: আলোচনা (ডিসকাশন), পরামর্শ (অ্যাডভোকেসি) এবং উসকানি (ইনসাইটমেন্ট)—শেষটি ছাড়া কোনও কিছুই ১৯(২) ধারার আওতায় ফেলে পাবলিক অর্ডার ভঙ্গ করার অভিযোগ আনা যাবে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ— ইনসাইটমেন্ট বা উসকানি সুদূর বা পরোক্ষ হলেও সেটা অপরাধ বলে ধরা যাবে না। কারও কথা বা কাজ হিংসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত হলেই (বারুদের মধ্যে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি ফেলার মতো) কেবল তাকে এই ধারায় ফেলা যাবে। 

এই ১৯(২) ধারার সঙ্গেই ইউএপিএ যুক্ত, তাই এই ইতিহাসটা এখানে অত্যন্ত জরুরি। একটি বহুসংস্কৃতির দেশে, গণতন্ত্রের দেশে, সর্বোচ্চ আদালতের ওই দিগদর্শনটি ছিল স্পষ্ট, ঋজু আর বিবেচনাসম্পন্ন। ২০১৯ সালের ইউএপিএ সংশোধনীর মাধ্যমে মোদী-শাহ সুপ্রিম কোর্টের এই দিগদর্শনকেই বরবাদ করেছিলেন। তার পর থেকে নতুন দেশদ্রোহ ধারায় চলছে মোদীজির নতুন দেশ।        

করোনা চলছে। চলছে ইউএপিএ-ও। ভারত আমার ভারতবর্ষ, মৃত্যুসন্তপ্ত রোগসন্ত্রস্ত বিভ্রান্ত বিপর্যস্ত। বিপর্যয় তো কেবল রোগে নয়, তার আড়াল দিয়ে লুকিয়ে চলা আরও অনেক কিছুতেই। দিল্লি চার্জশিটের সূত্রে সে সব কি মনে পড়ল কিছুটা? সামান্য উসখুসও কি হল কোথাও?

সৃজনমেলা

(Ei-Samay, 13th November, 2016. By Partha Acharya)

শৃঙ্গ বিজয় অনেকেই করেছেন , করবেন — তা সত্যি সত্যিই শৃঙ্গ বিজয় কিনা সে নিয়েও তর্ক-বিতর্ক চলবে৷ কিন্ত্ত শৃঙ্গ বিজয় করে তাকে শিল্পপীঠ করে তোলা ? এমনটা শুনেছেন ক’জন ?ছোটো টিলা পাহাড় , তাকে ঘিরে রাখা শাল , শিশু , মহুয়া , পলাশের জঙ্গল৷ একই সঙ্গে সেই জঙ্গলে পাওয়া যাবে দরিদ্র শিশুর মতো (যে শিশুদের ছবি নিজেদের প্রচার পুস্তিকা কিংবা উপস্থাপন ব্যবহার করে বাহবা কুড়ায় পৃথিবীখ্যাত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি ) শীর্ণ এক নদীকে৷ রাসপূর্ণিমার কুয়াশার চাদর মুড়ে রেখেছে গোটা পাহাড় , জঙ্গলকে৷ কোনও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন নেই৷ পুরুলিয়ার খড়িদুয়ারার কুমারীগ্রামের টিলা পাহাড়ের তিন শৃঙ্গকে ঘিরে সৃজন ভূমি৷ প্রথাগত মঞ্চ নেই, উত্সবের আড়ম্বর নেই৷ অথচ তিন দিনের সৃজন উত্সবে মেলা জমান অগণিত মানুষ৷ এই শৃঙ্গ বিজয় যে সকলের৷ তাই নেই কোনও স্বেচ্ছাসেবক , নেই কোনও নেতা , মন্ত্রীর উপস্থিতি৷ নেই কোনও বিশৃঙ্খলা কিংবা হাঙ্গামাও৷ রাসপূর্ণিমায় এ দেশের প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রগুলি আচমকাই বেজে ওঠে একসঙ্গে৷ যেন দেশজ কনসার্ট! কুমারী গ্রামের সৃজনভূমির তিন শৃঙ্গ মেতে ওঠে জয়ের আনন্দে৷ সৃজন উত্সব৷ গত ২২ বছর ধরে এ ভাবেই চলে আসছে বাংলার ভারত মেলা৷

Continue reading “সৃজনমেলা”

অঙ্কের রকস্টার (পথিক গুহ)

(আনন্দবাজার)

রবিবারের সকাল আটটা। নিউ টাউনের পাঁচতারা হোটেলে তখনও ব্যস্ততার ছোঁয়া লাগেনি। রিসেপশনে খবর দিতে তিনি নেমে এলেন। পরনে থ্রি-কোয়ার্টার ট্রাউজার্স, গেঞ্জি। এবং বুকে এক কোণে ট্রেডমার্ক মাকড়সা ব্রোচ। সঙ্গী ফোটোগ্রাফারকে দেখে বললেন, ছবিও তুলবেন দেখছি। তা হলে তো পোশাকটা পালটাতে হয়। বলেই চলে গেলেন নিজের স্যুইটে। ফিরে এলেন দ্রুত। এ বারে থ্রি-পিস। গলায় টকটকে লাল স্কার্ফ। এবং আর একটা মাকড়সা ব্রোচ।

তিনি সেডরিক ভিলানি। বয়স ৪২। প্যারিসে অঁরি পঁয়েকারে ইনস্টিটিউট-এর ডিরেক্টর। গণিতে নোবেল প্রাইজ নেই, কিন্তু গ্ল্যামারে যা তার সমতুল, সেই ‘ফিল্ডস মেডেল’ বিজেতা। বাষ্প অবস্থায় তড়িৎযুক্ত কণা বা প্লাজমা-র বিশেষ ধর্ম— কেতাবি নাম ‘লানদাউ ড্যাম্পিং’— জটিল গণিতে ব্যাখ্যা করে পণ্ডিতদের নজর কেড়েছেন। তবে ও সব বর্ণনায় তাঁকে চেনা যাবে না।

আজকের দুনিয়ায় ফিজিক্সের যদি এক জন স্টিফেন হকিং থাকেন, তবে অঙ্কের আছেন সেডরিক ভিলানি। হ্যাঁ, গণিত চর্চা করেও জনমানসে খ্যাতিতে তিনি যেন এক জন রকস্টার। বক্তৃতা দিতে ঘুরে বেড়ান সারা পৃথিবী। তাঁর ভাষণে যতটা মুগ্ধ হয় মানুষ, ততটাই আকৃষ্ট হয় তাঁর কেতাদুরস্ত বেশভূষায়। যা দেখে লজ্জা পাবেন যে-কোনও হলিউ়ড অভিনেতা। দামি থ্রি-পিস এবং স্কার্ফের সঙ্গে সব সময় থাকে ভিলানির প্রিয় মাকড়সা ব্রোচ।

ব্রোচ হিসেবে মাকড়সাই পছন্দ কেন? সেটা একটা রহস্য! ভিলানি কাউকে ব্যাখ্যা করেননি আজ পর্যন্ত। করবেনও না কোনও দিন। সব রহস্যের সমাধান চাই বুঝি? ব্যাপারটাতে বেশ মজা পান তিনি— যখন দেখেন কোনও সাংবাদিক তাঁর কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা না পেয়ে নিজেই একটা উদ্ভট ব্যাখ্যা খাড়া করেন! ভিলানি বলেন, গণিতের কচকচির বাইরে থাকতে ওটা নাকি একটা কমিক রিলিফ!

তবে হ্যাঁ, মাকড়সা ব্রোচ ভিলানি এত ভালবাসেন, তাঁর সংগ্রহে আছে শ’খানেক। যেটা দেখলাম আমরা কোটের বুকে, সেটা নাকি আফ্রিকান এক বন্ধুর উপহার। ওই মহাদেশের মরুভূমিতে মেলে, এমন মাকড়সার নকল ওটা।

জিজ্ঞেস করলাম, কখন বুঝলেন গণিতজ্ঞ হবেন? বাবা-মা’র প্রেরণা ছিল?

ভিলানি জানালেন, না, তেমন কোনও মুহূর্ত আলাদা করে আসেনি। আর বাবা-মা তো কোনও কিছুর দিকে জোর করে ঠেলে দেওয়ার কথা ভাবতেই পারতেন না। ওঁরা দুজনেই ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। পড়াতেন ফরাসি সাহিত্য। কাকা-জ্যাঠারাও শিক্ষা জগতের মানুষ। পড়াশুনোর ভাল পরিবেশ ছিল বাড়িতে। তবে গণিতে চলে যাওয়ার মূলে তাঁর ক্ষেত্রে অন্য কারণ ছিল হয়তো।

ছোটবেলায় ঘন ঘন ভুগতেন। এখন অবশ্য তিনি শারীরিক ভাবে যথেষ্ট ফিট। সাত বছর আগে ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর হওয়ার পর থেকে, ট্যুর বাদ দিলে এক দিনও অসুস্থ হয়ে ইনস্টিটিউটে গরহাজির থাকেননি। আর ছেলেবেলায়? প্রায় ৩০ শতাংশ দিন স্কুলে যেতে পারতেন না অসুস্থতার কারণে। হুটোপাটির খেলাধুলো বাদ। তার ওপরে ছিলেন দারুণ মুখচোরা। বাড়িতে-শুয়ে-থাকা এমন ছেলের পক্ষে গণিতকে ভালবেসে ফেলা বোধহয় স্বাভাবিক।

ফিল্ডস মেডেল পালটে দিয়েছে তাঁর জীবন। অনেকটা। এখন তাঁর পাবলিক লাইফ অনেকখানি।

ভাল লাগে? মনে হয় না গবেষণার সময় কমে যাচ্ছে?

না, বরং ভাল লাগে, যখন দেখেন সমাজে গুরুত্ব পাচ্ছেন। একটা উদাহরণ দিলেন। ফরাসি সরকার বিজ্ঞান গবেষণায় আর্থিক বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছেন। অনেকে মিলে প্রতিবাদ করে চিঠি দিয়েছেন সরকারকে। চিঠিতে তাঁর স্বাক্ষরের দাম বেড়ে গিয়েছে শুধু এ কারণে যে, তিনি ফিল্ড মেডালিস্ট, লোকে তাঁর নাম জানে। পাবলিক লাইফে থাকার জন্য মিডিয়া ট্রেনিংও নাকি নিয়েছেন।

মানে?

এই যেমন, ফরাসি হয়েও ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলা। এক কালে মুখচোরা হওয়া সত্ত্বেও এখন অনেক পাবলিক লেকচার দিয়ে বেড়ানো। এ সব এক-একটা স্কিল। রপ্ত করতে হয়।

ওঁকে জানালাম এই অধম সাংবাদিকের এক অপমানজনক অভিজ্ঞতার কাহিনি।

‘জানেন, সেটা ২০১০ সাল। হায়দরাবাদে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ম্যাথমেটিশিয়ানস-এ, যেখানে আপনি পেলেন ফিল্ডস মেডেল, সেখানে নিউ ইয়র্কে কুরান্ট ইনস্টিটিউট-এর প্রথিতযশা অধ্যাপক লুই নিরেনবার্গ-কে দেওয়া হল ‘চার্ন মেডেল’। ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি মনে করেন, ভিনগ্রহের জীবদের সঙ্গে যোগাযোগে গণিত-নির্ভর সিগনালই শ্রেষ্ঠ উপায়? ব্রহ্মাণ্ড গণিত-নির্ভর। যে-কোনও উন্নত সভ্যতা গণিত বা সংখ্যা শিখতে বাধ্য। সুতরাং, গণিতের ভাষায় কথা বলা কি যোগাযোগের শ্রেষ্ঠ উপায় নয়?

‘অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, প্রশ্ন শুনে নিরেনবার্গ বিরক্ত হলেন। ব্যঙ্গের সঙ্গে জবাব দিলেন, আপনার খবরের কাগজ বোধহয় ই.টি. নিয়ে খুব ভাবে? অপমানে আমি থ!’

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ভিলানির মন্তব্য: তা হলেই দেখুন গবেষকদের মিডিয়া ট্রেনিং দরকার কি না। আপনার প্রশ্নটা তো সংগত। নিরেনবার্গ কেন যে তাৎপর্য না বুঝে ওই রকম রিঅ্যাক্ট করেছিলেন, তা আমি বলতে পারব না। ইন্টারভিউয়ের সময় আপনার নিশ্চয়ই মনে ছিল কার্ল সাগানের ‘কনট্যাক্ট’ উপন্যাসের কাহিনি। যেখানে ই.টি.-দের তরফে প্রাইম নাম্বারে পাঠানো রেডিয়ো সিগনাল দেখেই নায়িকা জ্যোতির্বিজ্ঞানী বুঝেছে— ওই সংকেত মহাশূন্য থেকে আসা হাবিজাবি বিপ নয়, বরং বুদ্ধিমান কোনও প্রাণীর পাঠানো সংকেত। আমাদের ইনস্টিটিউটে বিজ্ঞান-নির্ভর ফিল্ম দেখানো হয় বছরে কয়েক বার। ওখানে ওই ছবিটার স্ক্রিনিং হয়েছে।

গণিত নিয়ে প্রশ্নোত্তর, আর তাতে রামানুজন উঁকি দেবেন না, কখনও হয়? জানতে চাইলাম, ‘দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি’ হলিউডি ছবিটা দেখেছেন কি না। ভিলানি এখনও দেখেননি ছবিটি। প্যারিসে আসেনি। নানা জায়গায় রিভিউ পড়েছেন। তাঁর মনে হয়, হলিউডে ছবিটি তেমন কদর পাবে না, যেমন পেয়েছিল ‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’ কিংবা ‘গুডউইল হান্টিং’।

কেন?

হলিউড গল্প চায়, সত্য চায় না। জন ন্যাশ-এর জীবন নিয়ে তৈরি ছবি ‘আ বিউটিফুল মাইন্ড’ অনেকটাই বানানো। আর ‘গুডউইল হান্টিং’ তো কল্পকাহিনিই। সে দিক থেকে ‘দ্য ম্যান হু নিউ ইনফিনিটি’ তথ্য-নির্ভর, এবং রামানুজনের জীবনের অনেক কাছাকাছি। তাই হলিউডের ও-ছবি ভাল লাগবে না। ভিলানি কিছু দিন আগে পড়েছেন একখানি বই। ‘মাই সার্চ ফর রামানুজন’। লেখক আমেরিকায় এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেন ওনো। সেই পণ্ডিত, যিনি রামানুজনের বায়োপিকে গণিত উপদেষ্টা ছিলেন।

ওনো লিখেছেন তাঁর ছোটবেলার কথা। পড়াশুনোয় কতটা খারাপ ছিলেন তিনি, কী রকম বকা খেতেন মায়ের কাছে। তার পর গণিতের অধ্যাপক বাবার কাছে এক দিন শুনলেন শ্রীনিবাস রামানুজন নামে এক জনের কাহিনি। সেই গল্প পালটে দিল ওনো-র জীবন। গণিতকে ভালবেসে ফেললেন তিনিও। ‘ভাবুন তো এক বার’, বললেন ভিলানি, ‘কত দিন আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন মানুষটা, এত দিন পরেও এক জন ছাত্রকে এতখানি অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছেন তিনি। আচ্ছা, রামানুজনের স্ত্রী কেন প্রায় অর্ধ শতাব্দী আর্থিক কষ্টের মধ্যে জীবন কাটিয়েছিলেন?’

আমি নিরুত্তর।

আর এক জন। পুরো নাম গডফ্রে হ্যারল্ড (জি এইচ) হার্ডি। গত শতাব্দীর প্রাতঃস্মরণীয় গণিতজ্ঞ। নানা কারণে বিখ্যাত। তার মধ্যে একটা অবশ্যই রামানুজনকে ‘আবিষ্কার’। মাদ্রাজের পোর্ট ট্রাস্ট অফিসে যৎসামান্য মাইনের কেরানি রামানুজন তো তাঁর গণিতচর্চার (পেশা নয়, নেশা হিসেবে) ফলাফল জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন কত পণ্ডিতকে। কেউ উত্তর দেননি। ব্যতিক্রম ওই হার্ডি। চিঠি পড়ে তিনি থ। এমন প্রতিভা পচে মরছে কেরানিগিরি করে! বৃত্তি দিয়ে রামানুজনকে নিয়ে গিয়েছিলেন কেমব্রিজে। তার পর তো ইতিহাস। জিনিয়াসে জিনিয়াস চেনে।

পাণ্ডিত্য এবং ওই উপাখ্যান বাদ দিলেও হার্ডি খ্যাত নানা কারণে। তাঁর বই ‘আ ম্যাথমেটিশিয়ান’স অ্যাপোলজি’ হার্ডিকে দিয়েছে অমরত্ব। যার পাতায় পাতায় ফুটে উঠেছে তাঁর চরিত্র। তা কেমন? হ্যাঁ, গণিত গবেষণায় হার্ডি রীতিমত উন্নাসিক। ভালবাসেন গণিতের নান্দনিক দিক। বিমূর্তের সাধনা। পিয়োর ম্যাথমেটিক্স। যা কোনও কাজে লাগে না। মন মাতায় শুধু সৌন্দর্যে। আর অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্স? যা কাজে লাগে ব্রিজ বানাতে কিংবা যুদ্ধে? সে সব, হার্ডির মতে, ‘ইনটলারেব্‌লি ডাল’। অর্থাৎ, এলেবেলে।

ভিলানিও কি তাই মনে করেন?

একদম না! ওঁর মতে, ও রকম দৃষ্টিভঙ্গি তো ‘মনস্ট্রাস ওয়ে অব থিংকিং’। অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্সকে ও ভাবে খাটো করা ভুল। আসলে হার্ডির যুগে অনেক কিছু জানা ছিল না। যেমন জানা ছিল না, ওঁরই গবেষণা পরে কাজে লাগবে জিন বিশ্লেষণে। হার্ডির সেই বিখ্যাত গর্ব— কাজে লাগবে, এমন কোনও কিছু আমি জীবনে করিনি, আমার কোনও গবেষণায় মানুষের ন্যূনতম লাভ বা ক্ষতি কখনও হয়নি বা হবেও না— সে তো হাস্যকর শোনায় এখন।

হার্ডির কাজ ছিল নাম্বার থিয়োরিতে। মানে, ১, ২, ৩, ৪ ইত্যাদি সংখ্যার ধর্ম ঘাঁটাঘাঁটিতে। হার্ডি ভেবেছিলেন ও-কাজ কারও উপকারে লাগবে না। হায়, আজ যে রামের ই-মেল শ্যাম পড়ে ফেলতে পারছে না (পাসওয়ার্ড), কিংবা যদুর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে মধু টাকা আত্মসাৎ করতে পারছে না (পার্সোনাল আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার বা ‘পিন’), সে সব সুরক্ষা তো ওই নাম্বার থিয়োরির আশীর্বাদেই। ভিলানি বললেন, ‘এ সবের পরেও গণিতকে বিশুদ্ধ আর ব্যবহারিকে আলাদা করি কী করে? আমার মনে হয়, অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্স পিয়োর ম্যাথমেটিক্সের গ্ল্যামার বাড়ায়।’

‘বার্থ অব আ থিয়োরেম: আ ম্যাথমেটিকাল অ্যাডভেঞ্চার’। ২৭০ পৃষ্ঠার বই। লেখক ভিলানি। তাঁর মেজাজ-মর্জি টের পাওয়া যায় বইখানা হাতে নিলে। প্রচ্ছদে তিনি। গম্ভীর মুডে। পেছনের মলাটেও তিনি। এ বার ছবি পাগলাটে। ব্যাকড্রপ বলতে একখানা পেল্লায় ব্ল্যাকবোর্ড। তাতে একগাদা ফর্মুলা। অচেনা অক্ষর। দুর্বোধ্য চিহ্ন। হিজিবিজি। আর তার সামনে ভিলানি। শান্তশিষ্ট ভাবে দাঁড়িয়ে নয়। চার হাত-পা শূন্যে ছুড়ে লাফ দেওয়ার ভঙ্গিতে। বিদঘুটের ব্যাকড্রপে খ্যাপামি। এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায়।

আর বইয়ের ভেতরটা? পাতা ওলটাতে ওলটাতে মনে পড়বেই দুজনের কথা। স্টিফেন হকিং, রজার পেনরোজ। নিজের দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার খরচ জোগাতে হিমশিম হকিং ভেবেছিলেন বিজ্ঞানের এমন একখানা জনপ্রিয় বই লিখবেন, যা বিক্রি হবে এয়ারপোর্টের বুক স্টলে। ১৯৮৮ সালে ছাপা সে বই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম: ফ্রম বিগ ব্যাং টু ব্ল্যাক হোল’। ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম ও সম্ভাব্য মৃত্যুকাহিনি। সে বই লেখার সময় হকিং-এর পাবলিশার সতর্কবাণী শুনিয়েছিলেন— বইতে একটা ফর্মুলা মানে তার বিক্রি অর্ধেক কম! উপদেশ মেনে লেখা বই সুপারডুপার বেস্টসেলার। এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে কোটি কোটি কপি।

হকিংয়ের বন্ধু পেনরোজ। এক সময় গবেষণাও করেছেন দুজনে। সেই পেনরোজ বই লিখলেন হকিং-এর পরের বছরই। ‘দি এম্পেরর’স নিউ মাইন্ড: কনসার্নিং কম্পিউটরস, মাইন্ডস অ্যান্ড দ্য ল’জ অব ফিজিক্স’। ৬০০ পৃষ্ঠার বইটির বিষয়ের ব্যাপ্তি বিশাল। রিলেটিভিটি, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, কসমোলজি, কম্পিউটর সায়েন্স, নিউরোসায়েন্স,  আরও কত কী! মজার ব্যাপার, পাবলিশারের সতর্কবাণী এখানে উধাও। বিষয় ব্যাখ্যার জন্য ফর্মুলা তো যত্রতত্র আছেই, তার ওপর আছে পাতাজোড়া অঙ্ক। প্রকাশকের পরামর্শ ঠিক হলে যে বই কাটতির বদলে পোকায় কাটার কথা। বাস্তবে বিক্রি? পুরনো গাড়ি কিনবেন পেনরোজ, পাবলিশারকে ফোন করলেন, যদি সামান্য কিছু পাউন্ড মেলে রয়ালটি বাবদ। প্রকাশক জানালেন, যা রয়ালটি তিনি পাবেন, তাতে কয়েকটা নতুন গাড়ি কিনতে পারেন পেনরোজ!

বইয়ের বিক্রি বাড়াতে হকিং-এর প্রকাশকের উপদেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন ভিলানিও। তবে তিনি পেনরোজ-এর চেয়েও দশ কাঠি সরেস। ‘বার্থ অব আ থিয়োরেম’ হাতে নিয়ে পাঠক ভিরমি খাবেন, আঁতকে উঠবেন। পাতায় পাতায় জটিল দুর্বোধ্য সব ফর্মুলা, অঙ্ক। কোথাও ছিটেফোঁটা নেই ওগুলোর ব্যাখ্যা। পড়তে গেলে হোঁচট খেতে হয় পদে পদে। বইখানা লানদাউ ড্যাম্পিং আবিষ্কারের আগের এবং পরের কাহিনি। সে হিসেবে বইয়ের সাব-টাইটেল হতে পারত ‘হাউ আই গট দ্য ফিল্ডস মেডেল’। কিন্তু ঠিক কী আবিষ্কারের জন্য ওই শিরোপা, তা জানতে পারবেন না পাঠক।

কেন লিখলেন এমন বই?

ভিলানির ঠোঁটের কোণে তেরচা হাসি। মনে হল প্রশ্নটা হাজার বার শুনেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা: ‘আমি তো গণিত ব্যাখ্যা করতে বই লিখিনি। আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করা হয়, গণিত গবেষণার অনুভূতিটা কী রকম? গণিতজ্ঞের দৈনন্দিন জীবন কেমন? তাঁর কাজ এগোয় কী ভাবে? বইতে আমি আমার মতো করে ও-সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। গবেষণার ফলাফল নয়, আমি বর্ণনা করেছি একটা ম্যাথমেটিকাল জার্নি, একটা খোঁজ। অজানায় ঝাঁপ দেওয়ার মুহূর্ত থেকে সেই তখন, যখন কোনও ফলাফল— একটা নতুন থিয়োরেম— বিখ্যাত জার্নালে ছাপার জন্য মনোনীত হচ্ছে, ততটা পথ কী রকম, তা বলার চেষ্টা করেছি। কেমন সে পথের কাঁটাগুলো? সন্দেহ, ঈর্ষা, উদ্বেগ, হতাশা আর সব শেষে সাফল্যের আনন্দ। গণিত নয়, গণিতজ্ঞের মনটা মেলে ধরার চেষ্টা করেছি আমি।’

ঠিক বলেছেন ভিলানি। মনে পড়ল ‘বার্থ অব আ থিয়োরেম’-এর একটা জায়গা। ২০০৯ সালের এক সন্ধ্যা। ইনস্টিটিউট থেকে ফিরেছেন ভিলানি। তিনি ঢুকে পড়লেন ওঁর ছেলে-মেয়ের ঘরে। দরজা বন্ধ, লাইট অফ। অন্ধকারে পায়চারি করছেন গবেষক। কয়েক মিটার দূরে কিচেনে ওঁর স্ত্রী ক্লেয়ার। গোটা পরিবারের ডিনার রেডি করায় ব্যস্ত। স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় কত ফারাক! স্ত্রী ব্যস্ত নর্মাল কাজে। স্বামী মত্ত অ্যাবনর্মালে। ভিলানি লজ্জিত। তবুও ডিনার সেরে ফের সেই অন্ধকার ঘরে। আবার পায়চারি। আবার মাথা খুঁড়ে মরা। গণিতজ্ঞের কাজই যে এমন। অন্ধকারে হাতড়ানো। সুন্দরকে ছুঁয়ে দেখার অপেক্ষায়।

কিন্তু, ওই যে পাতার পর পাতা জুড়ে হিজিবিজি ফর্মুলা, কোথাও কোনও ব্যাখ্যা নেই, ওগুলো কি জরুরি ছিল?

মূল ফরাসিতে যখন পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করছেন, তখন একটা সন্দেহ নাকি ভিলানির মনেও ছিল। প্রকাশক ছাপবে তো? অবাক হলেন, যখন ফরাসি প্রকাশনা সংস্থা বলল, ফর্মুলায় কুছ পরোয়া নেই। কেন? ওঁরা নাকি ওই দুর্বোধ্য চিহ্নগুলোকে বইয়ের ইলাস্ট্রেশন হিসেবে দেখছেন! যেন পাতায় পাতায় উদ্ভট কতকগুলো ছবি! চমৎকার যুক্তি। আরও অবাক কাণ্ড, পাবলিশার ওটাকে ‘ফিকশন’ হিসাবে বিক্রি করেছেন! বইটা ফ্রান্সে বেস্টসেলার হয়েছে। বারোটা ভাষায় অনুবাদ ছাপা হয়েছে। ফিকশন ঘোষিত না হলেও, ব্রিটেনে বইখানা সমাদর পেয়েছে। তবে আমেরিকান পাঠক বইটা সম্পর্কে তেমন উৎসাহ দেখায়নি।

কারণটা হতে পারে আমেরিকান মানসিকতা। রহস্যের বদলে যা চায় তার সমাধান। সে জন্য বোধ হয় ফর্মুলাগুলোকে স্রেফ ছবি হিসেবে দেখায় আপত্তি।

আমি বললাম, ‘আপনি দেখছি আইনস্টাইনের আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করেন। তিনি বলেছিলেন, কোনও কিছু যতটা সরল করা যায়, ততটা করাই ঠিক, তার চেয়ে বেশি নয়।’

ভিলানি: ‘ঠিক তাই। আমি বোঝানোর চেষ্টা করলেই কি পাঠক লানদাউ ড্যাম্পিং বুঝত? যে যা-ই গ্ল্যামার আরোপের চেষ্টা করুক গণিতের ওপর, আমাদের মনে রাখা উচিত, ম্যাথ ইজ হার্ড।’

শেষ শব্দটার উচ্চারণে বিশেষ জোর। হার্ড নয়, হা-আ-র্ড।

Is West Bengal’s economy actually reviving under Mamata Banerjee?

Continue reading “Is West Bengal’s economy actually reviving under Mamata Banerjee?”

Cameos / The Legacy for Tomorrow

Gurudev Rabindranath Tagore’s 155th birth anniversary falls on Sunday (May 8, 2016). On this occasion we are reproducing two pieces by N.C. on Tagore written 75 years ago, in 1941. Both were published in The Calcutta Municipal Gazette—Tagore Memorial Special Supplement, September 13, 1941 (that appeared after the Poet’s death on August 7, 1941). The first piece was carried under the pseudonym Vanguard. Though written during World War II when the global scenario was radically different from what it is today, the relevance of these pieces remains undiminished.

Continue reading “Cameos / The Legacy for Tomorrow”

প্রজাতন্ত্র নেই, আছে অবিমিশ্র রাজতন্ত্র

দলের ওপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য সংক্রমিত হয়েছে সরকার পরিচালনায়। এই মমতাশাহি দেখলে ছাত্রজীবনে দেখা ইতিহাসের মাস্টারমশাই নির্ঘাত বলতেন ‘দি অ্যাবসোলিউট মনার্কি অব বেঙ্গল’।

পার্থ চট্টোপাধ্যায়

Anandabazar Patrika, 19th April 2016

Continue reading “প্রজাতন্ত্র নেই, আছে অবিমিশ্র রাজতন্ত্র”

জ্যামিতির গোড়ার কথা – স্বর্নেন্দু শীল

বিজ্ঞান ডট অর্গ ডট ইন -এ স্বর্নেন্দু শীল লিখছেন জ্যামিতি নিয়ে।  ইউক্লিড থেকে রীম্যান। তারকার ছড়াছড়ি।

মুল লেখা গুলোর লিঙ্ক দিচ্ছি। তারপর পুনঃপ্রকাশ।

প্রথম পর্বে আমরা শুরু করেছিলাম জ্যামিতিতে আদৌ কিছু দেওয়া আছে কিনা এই প্রশ্ন দিয়ে, দেখেছিলাম যে ইউক্লিডীয় জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধগুলো আসলে সেই দেওয়া থাকা জিনিসগুলো। কিন্তু কি বলছে সেগুলো? প্রথম পর্বে শুধুই প্রথম স্বতঃসিদ্ধ কি বলছে দেখেছিলাম। দ্বিতীয় পর্বে দেখেছি জ্যামিতির বীজগাণিতিকরণ হয়ে কিভাবে কার্তেসীয় স্থানাঙ্ক জ্যামিতি এল, আর এই স্থানাঙ্ক জ্যামিতির হাত ধরে আমরা দেখলাম যে দ্বিতীয়, তৃতীয় আর চতুর্থ স্বতঃসিদ্ধ কি বলছে।  ইউক্লিডীয় দূরত্ব অপেক্ষক আর ইউক্লিডীয় ইনার প্রোডাক্ট কেও চিনলাম সেই পর্বেই। তৃতীয় পর্বে সমস্তটা জুড়েই আমরা মাথা ঘামিয়েছি পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধ নিয়ে।  দেখলাম পঞ্চম স্বতঃসিদ্ধ কি বলছে আর দেখেছি সেই স্বতঃসিদ্ধ কে পালটে নিলেও আমরা জ্যামিতি পাই, শুধু সেই জ্যামিতি আর ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নয়, অনিউক্লিডীয় জ্যামিতি। 

Continue reading “জ্যামিতির গোড়ার কথা – স্বর্নেন্দু শীল”

অভীক মিত্র-র ছবি

বন্ধু অভীক মিত্র ছবি তোলেন শখে। অথচ তার অনেক ছবিতেই এমন দৃষ্টি খোঁজার আকুতি থাকে যা নিতান্ত সহজ নয়। অভীকের অনুমত্যানুসারে তার তোলা কিছু ছবি থাকছে এখানে।

Continue reading “অভীক মিত্র-র ছবি”

‘তীর্থেন্দুর চোখে’ – তীর্থেন্দু ব্যানার্জীর ছবি

তীর্থেন্দুর ‘দুর্গা’ দেখে পথের পাঁচালির দুর্গার কথা মনে পড়ে গেছিল। সেই থেকে মাঝে মধ্যেই ফেসবুকে বা অন্যত্র ওর ছবি দেখে বেড়াই। ওর অনুমতি নিয়ে কিছু ছবি এখানে দেওয়া গেল।

Continue reading “‘তীর্থেন্দুর চোখে’ – তীর্থেন্দু ব্যানার্জীর ছবি”

চন্দনকাঠের লেখনী – শোভন ভট্টাচার্য

…, অনেকদিন পর, এমন একটা উপহার আজ পেলাম, যা কেবল, যে কোনো একটা
সৌজন্যমূলক গিফটমাত্রই নয়, যার সঙ্গে সাধারণত মিশে থাকে সামাজিকতার
শুকনো অভিশাপ। এক্ষেত্রে, মহীশূর চন্দনকাঠের এই লেখনীটি, কারও উপহার
হিসেবে মনস্থ করার পেছনে রয়েছে প্রাপকের রুচির প্রতি, ক্রিয়াকর্মসংস্কারের প্রতি,
গভীরতর এক সম্মাননা।

Continue reading “চন্দনকাঠের লেখনী – শোভন ভট্টাচার্য”