কিউবা এক অদ্ভুত দেশ। তার ভূমিপুত্র তাইনোরা কচুকাটা হল এস্পানিওলদের হাতে। তারপর সেই এস্পানিওলরাই হয়ে উঠল এখানকার প্রধান বাসিন্দা। তাদের ক্ষেতে, কারখানায় খাটতে এল আফ্রিকার থেকে ক্রীতদাস। তারাও হয়ে উঠল এখানকার মানুষ। হিস্পানিওলায় ক্রীতদাস বিদ্রোহে তাড়া খেয়ে পৌঁছল ত্রিশ হাজার ফরাসি জমিদার। তারাও কিউবার বুকে খুঁজে নিলো নিজের দেশ। এক চিলতে দেশ। তাতে কত বৈচিত্র। মানুষের, সংস্কৃতির, স্থাপত্যের, আদব কায়দার।
কিউবা কিন্তু তখনও পরাধীন। রাজদণ্ড স্পেনের হাতে বাঁধা। প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বিফল হল নির্মম ভাবে ১৮৭৮এ। কিন্তু সেই সংগ্রামের একটা দাবী আদায় করা গেল ১৮৮০তেই। দাসপ্রথা উঠে গেল কিউবার মাটি থেকে। এটুকু থেকেই অনুমান করা সম্ভব যে কি বিপুল প্রভাব ফেলেছিল প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ।
ষোল বছরের হোসে মার্তি ১৮৬৮তে জেল বন্দী হয়েছিলেন। কসুর ছিল বিদ্রোহের কবিতা লেখা। পরবর্তী কালে যুবক হোসে মার্তি বিদ্রোহের আগুন বুকে নিয়ে কিউবা থেকে দক্ষিণ আমেরিকায় পাড়ি দিলেন। লিখতে থাকলেন অসংখ্য প্রবন্ধ, কবিতা। তার অক্ষর ধরে কিউবার দ্বিতীয় বিদ্রোহের সলতে পাকানো চলতে থাকল। এদিক থেকে হোসে মার্তি একাধারে রাসবিহারি বসু এবং অরবিন্দ ঘোষের সমতুল্য। রাসবিহারি বসুর মত তিনি সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছেন স্বাধীনতার জন্য। অরবিন্দ ঘোষের মত তিনি লিখেছেন অজস্র লেখা এবং সেই লেখার হাত ধরে বহু যুবক বিপ্লবের স্বপ্ন গেঁথেছে। আমাদের দেশে যেমন যুগান্তর বা অনুশীলন সমীতি গড়ে উঠেছিল, ইতালিতে যেমন ছিল কারবোনারি, তেমনি হোসে মার্তি গড়ে তুললেন পিআরসি (পার্তিদো রেভ্যুলিশনারিও ক্যুবানো)। কিউবা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপ্লবী সংগঠন।
হোসে মার্তির ডাকে সাড়া দিলেন প্রথম বিপ্লবের দুই কাণ্ডারি, ম্যাসিও আর গোমেজ। ১৮৯৫ সালে মার্তির অনুগামিরা হাভানায় অভ্যুত্থান শুরু করলে। এস্পানিওলরা যখন সেই বিদ্রোহ সামাল দিতে ব্যস্ত, সেই ফাঁকে মার্তি তার দলবল নিয়ে মেক্সিকো থেকে পৌঁছলেন কিউবার বারাকোয়ায়। দেশে পৌঁছেই মার্তি সেনাবাহিনী গড়ে তুললেন। প্রায় চল্লিশ হাজার বিদ্রোহীকে নিয়ে যুদ্ধ ঘোষনা করলেন স্পেন রাজদণ্ডের বিরুদ্ধে। প্রথম সম্মুখ সমরেই হোসে মার্তির মৃত্যু হয়। উনিশে মে দস রিওসের অনামা যুদ্ধক্ষেত্রে মার্তির মৃত্যুর সাথে শেষ হয়ে গেল এক আমৃত্যু সংগ্রামী কবির জীবন। আজও কিউবার প্রতিটি শহরে মার্তির স্মৃতি জাগরুক হয়ে আছে।
মার্তি মরলেন বটে। রেখে গেলেন তার অনুগামি দের। তারা লড়াই চালাতে থাকল। এস্পানিওলরা নির্মম ভাবে বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করলে। হাজার হাজার কিউবানকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী করা হল যাতে তারা বিদ্রোহীদের সাহায্য না করতে পারেন। ১৮৯৬ সালে ম্যাসিও যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হলেন। হঠাৎ যেন স্বাধীনতা সংগ্রামের হাওয়া রাজার পক্ষে ঘুরে যেতে লাগল।
এই রকম এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করল মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র।
কিউবা তখন আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবসায়িক বন্ধু। বহু আমেরিকান ব্যবসা সূত্রে কিউবায় থাকেন। বিদ্রোহের গন্ধ পেয়ে আমেরিকান সরকার তার যুদ্ধ জাহাজ মেইন (Maine) কে পাঠিয়ে দিলো হাভানায়। উদ্দেশ্য বিদ্রোহের আগুন থেকে মার্কিন নাগরিকদের রক্ষা করা। ১৮৯৮ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। হাভানা উপকুলে মেইন জাহাজ এক বিপুল বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে গেল। মৃত্যু হল ২৬৬ জন আমেরিকান নাবিকের। আমেরিকা ভাবল যে স্পেন বুঝি তার জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে। সে স্পেনকে কিউবা কিনে নেওয়ার জন্য শেষবার একটা আবেদন পাঠালো। এবার দর তিনশো মিলিয়ান ডলার। স্পেন এবারও পত্রপাঠ নাকচ করে দিলে। আমেরিকার এই তৃতীয় চেষ্টা কিউবা কিনে নেওয়ার। এবারে সে আর অপেক্ষা করতে রাজি হলো না।
পয়লা জুলাই সান হুয়ান পাহাড়ে থিয়োডর রুসভেল্টের নেতৃত্ত্বে মার্কিণ বাহিনী কিউবা আক্রমণ করল। সতেরোই জুলাই-এর মধ্যে এই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। এস্পানিওলরা সম্পূর্ণ ভাবে পরাস্ত হয়।
আমেরিকানরা অবশ্য কিউবা সরাসরী দখলে রাখেনি। তারা একটা আধা স্বাধীনতার বন্দোবস্ত করলে। অভ্যন্তরীণ কাজে কর্মে কিউবা স্বাধীনতা পেলো। ১৯০০ সালে কিউবার আমেরিকান গভর্নর জেনারেল লিওনার্ড উড দরবার ডাকলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমেরিকার সংবিধানের মত করে কিউবার সংবিধান রচনা করলেন। আমেরিকান আর্মি এপ্রোপ্রিয়েশন বিলে এটুকু বলা রইল যে আমেরিকা যখনই মনে করবে কিউবার সামরিক কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
এ অনেকটা ব্রিটিশ আর দেশিয় রাজাদের মধ্যে ব্যবস্থার মত। স্বাধীনতা আছে। অথচ নেই!
এই গোটা শান্তি চুক্তিতে আমেরিকান আর এস্পানিওলদের কেউই বিদ্রোহীদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। অতএব কিছুটা প্রশমিত হলেও স্বাধীনতার হার না মানা আকুতি কিউবার হৃদয়ে জ্বলতেই থাকল।