কেন বেড়াতে যাই?
গগনচুম্বী অট্টালিকা দেখার সাধ আমার নেই। নিউইয়র্ক থেকে লণ্ডন, চৌরঙ্গি থেকে ডালাস, সে দেখেছি ঢের। শুষ্ক দেয়াল উঠেছে আকাশ ফুঁড়ে।
প্রকৃতির সৌন্দর্য্য? আমি বাংলার রুপ দেখেছি। হিমালয় থেকে স্কটিশ পাহাড়চূড়া অবধি স্পর্শ করেছি। সত্যি বলতে শুধু মাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখার জন্য কারোর ভারতবর্ষ ছেড়ে না নড়লেও চলে।
আমি বেড়াতে যাই মানুষের সাথে মিশব বলে। নতুন দেশ মানে নতুন মানুষ। যদি কোনো নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন মানুষের সাথে আড্ডাই না হল, তা হলে সে যাওয়ার কোনো মানে নেই। ঠিক এই কারণে আমার মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে যেতে আমার বিরক্ত লাগে। প্রতিটি মানুষ নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে তাদের অন্য কারোর সাথে কথা বলার ফুরসত টুকু নেই।
আর এই খানেই কিউবার জিত।
অঙ্গনা গতকাল শাড়ি পড়েছিল। আমি পড়লাম পাঞ্জাবি। এনেছি যখন পড়ে ফেলা যাক, ভাবটা খানিক এরকম। আর তারপর যেন ম্যাজিক ঘটে গেল।
হাভানার রাস্তায় প্রায় ডজন খানেক মানুষ আমাদের সহাস্য মুখে অভিনন্দন জানালেন, ‘লা ইন্ডিয়া! কালকুতা! টেগোর! গান্ধী!’ সহসা বুঝলাম যে কিউবানরা ভারতীয় দের খুবই পছন্দ করে। তার একটা কারণ হয়ত হিন্দী ছবি। ট্রেড এমবার্গোর কারণে হলিউড এখানে তেমন দাঁত ফোঁটাতে পারেনি। তারই জায়গা নিয়েছে বলিউড। বিনোদন তো চাই। আর আছেন রবীন্দ্রনাথ।
সেন্ট্রাল প্লাজায় দেখা হয়ে গেল দুই বাঙালি পর্য্যটকের সাথে। মা ও মেয়ে বেড়াতে এসেছেন। চট্টগ্রামে আদি বাড়ি হলেও ওরা থাকেন নিউইয়র্কে। মা কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। মেয়ে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সাইন্স পড়ছে।
’আমি আইন নিয়ে পড়তে চাই ভবিষ্যতে। আপাতত একটা সোশ্যাল অর্গানাইজেশনে কাজ করছি। ওরা ইমিগ্রেশন নিয়ে সাউথ এশিয়ান দের সাহায্য করে।’ মেয়েটি আমায় জানালো।
‘নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে পুলিশের উৎপাত বেড়েছে আজকাল। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের খুব ধরছে। কাগজপত্র ঠিক না থাকলেই দেশে চালান করছে। আমরা নবাগতদের তাদের অধিকার সম্পর্কে অবহিত করি। নারী স্বাধীনতার ওপর কাজও হয়।’
ভদ্রমহিলার পায়ে সর্ষে। শান্তিনিকেতন থেকে কফি হাউস, মেলবোর্ণ থেকে নেদারল্যাণ্ডস, তিনি বহু জায়গায় গেছেন। আমাদের কফি খাওয়ালেন। একদম বাঙালি আড্ডা জমে গেল বিকেলের হাভানায়।
ইতিমধ্যে পথে এক সিগার শ্রমিক জেসাসের সাথে আলাপ হল। সে ‘লা ইন্ডিয়ান’ বলে থমকে গিয়ে আমাদের সাথে আড্ডা জুড়েছে। তার থেকে কিউবার সম্বন্ধে বেশ কিছু কথা জানতে পারলাম। কতক গুলো আগেই শুনেছিলাম। রবের্তো বা মারিওর কাছে, ত্রিনিদাদে। কতকটা নতুন।
বিকেলে দেখা হলো সারিমার সাথে। অর্জুনদার (আমার শ্যালক) বন্ধু। লন্ডনে পড়ার সময় ওদের বন্ধুত্ত্ব হয়েছিল।
সারিমা ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাতে চায়, ‘আমি ছোটো থেকেই হাভানায় আছি। এখানে মানুষজন খুব রিল্যাক্সড থাকে। তুমি যদি খুব ব্যস্ত হও, তাহলে সম্ভবত তোমার হাভানাতে খুব একটা বন্ধু হবে না।’ ও হাসতে হাসতে বলল। আমরা বসেছিলাম সান লাজারাস আর ইনফ্যান্টার মোড়ে, একটা ক্যাফেতে।
মানুষ মানুষ! জ্যান্ত মানুষ সর্বত্র। তারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কথা বলছে। গান গাইছে। কেউ বা কফি খাওয়াচ্ছে, ফল উপহার দিচ্ছে। হেমিংওয়ের পধধূলিধন্য কাফে লা বোদেগিতার দেওয়ালে তাই বাঙলায় লিখে এসেছি এক লাইন। এত প্রাণ যে শহরে সে তো আমারই কলকাতা।