রকিং চেয়ারে দুলে দুলে টিভি দেখছেন ওলগা। মুরিশ স্থাপত্যের কথা বইতেই পড়েছি। মস্ত সিলিং, আর্চ করা ব্যালকনির দরজা, মিনে করা মেঝে! যেন উত্তর কলকাতার কোনো বনেদি বাড়িতে এসে পড়েছি অকস্মাত।
ওলগা আমাদের গৃহস্বামীর মা। এক বিন্দু ইংরাজি বোঝেন না। অতএব আমরা ইংরাজি আর তিনি এস্পানিওলে দিব্যি হুড়মুর করে কথা বলে গেলাম।
গৃহস্বামী পাবলোর শরীরে স্পষ্টতই এস্পানিওল রক্ত বইছে। মধ্যবয়সী পুরুষ। বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা চেহারা। ভাঙাভাঙা ইংলিশে সান নিকোলাস সরণির এক বনেদি বাড়িতে তিনি আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন।
বাড়ির থেকে কিছুটা দূরেই ক্যারাবিয়ান সাগর। সুবিশাল অতলান্তিকের ঢেউ হাভানার তীরে আছড়ে পড়ছে। আমি আর অঙ্গনা অভিভূত হয়ে পড়লাম। শহরটা যেন ষাটের দশকের এক মায়াচ্ছন্ন স্প্যানিশ রুপকথা। প্রাচীন হুডখোলা আমেরিকান গাড়ি ছুটে বেড়াচ্ছে উপকুল ধরে। মানুষ হো হো করে হাসছে, ছেলেমেয়েরা গলি জুড়ে খেলা করছে, গীটার হাতে কিশোর কিশোরি রোজগারের ফিকিরে গান ধরেছে। অঙ্গনাও তাদের সাথে গলা মেলালো। ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী।’ হাভানার মালেকনে আমরা রবিঠাকুরের সুর ভাসিয়ে দিলাম। সাথে শক্তির পদ্যও খানিক রইল।
সমুদ্রতটে যে বিশালকায় বাড়িগুলো, তাদের গায়ে কোনো বিজ্ঞাপন নেই। এ যেন এক অদ্ভুত স্বাধীনতা। বৃহদাকার কর্পোরেশনদের খেলার পুতুল ছিলাম এতদিন। হঠাৎ করে তাদের ক্রমাগত ‘কিনিয়ে’ দেওয়ার চক্কোর যেন মুক্তি পেয়ে গেছি।
ইন্টারনেট, ওয়াইফাই খুঁজতে গেলেই বিপদে পড়তে হবে। কিউবা সরকার শহরের কয়েক জায়গায় ওয়াইফাই হটস্পট করে রেখেছেন। ইন্টারনেট কার্ড কিনে তবে পাওয়া যাবে ওয়াইফাই। সেই বিশেষ বিশেষ এলাকায়। এ ব্যাপারটা ভালো না খারাপ তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তবে মানুষজনকে দেখে হঠাৎ অস্বস্তী হয়। তারা ফোনের স্ক্রীনে ডুবে নেই। একে অপরের চোখে চোখ রেখে কথা বলছে।
হাভানায় আসা অবধি একটা উত্তর কলকাতার গন্ধ আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। রসভঙ্গ হল জলের খোঁজ করতে গিয়ে। ঘর হোক বা রেস্তোরা, সর্বত্র জল কিনে খেতে হবে। ফ্রুটজুস দিচ্ছেন গৃহস্বামী (প্রাতরাশের সাথে)। জল? নৈব নৈব চ। সম্ভবত সমুদ্রে ঘেরা কিউবাতে জল মহার্ঘ্য। তাই এই ব্যবস্থা।