কেমন করে ২০০১ সালে চট্টগ্রামে পড়তে যাওয়া কৃষক পরিবারের সন্তান, ২০১৬ সালে আমতলি গ্রামে পৌঁছালেন? কি করে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৃষি বিজ্ঞানির সঙ্গে তার পরিচয় হল? কি করেই বা বিচিত্ররঙা ডিঙ্গামণি ধান তাদের তিল তিল করে গড়ে তোলা খামারে এসে পৌঁছালো? আর কেনই বা সে নিয়ে তার সুখের চেয়ে দুঃখের ভাগটাই বেশি?
শঙ্করদা বলতেন, ‘ইতিহাস সৃষ্টি করে জনগণ। আমরা মিথ্যেই রাজারাজরা আর তথাকথিত মহামানবদের গপ্পো পড়ে মরি।’
‘এ তোমার রাজনৈতিক গোঁড়ামো শঙ্করদা। আকবর বা অশোকের মত নৃপতি, রবীন্দ্রনাথ বা আইনস্টাইনের মত কীর্তিমান মানুষের অবদানকে তুমি অস্বীকার করতে চাইছ।’
শঙ্করদা চা-টা প্লেটে ঢেলে সরাৎ সরাৎ করে চুমুক দিতে দিতে কথা গুলো শুনত। ‘আচ্ছা আচ্ছা। আমি না হয় গোঁড়া কমিউনিস্ট। কিন্তু তুই তো গণিতের ছাত্র। যুক্তিই তোর ইশ্বর। কাউন্টার আর্গুমেন্টটা শোনার আগেই বাতিল করে দাওয়া কি তোর মানায়?’
‘কিসের কাউন্টার আর্গুমেন্ট?’
‘তুই হিউম্যান হিস্ট্রির ‘মহামানব ন্যারেটিভ’টায় বিশ্বাস করিস। অর্থাৎ মনে করিস যে, পৃথিবীতে মাঝে মধ্যে এরকম কীর্তিমান মানুষ জন্মান যারা তাদের একক ক্ষমতায় ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেন। তাই তো?’
পশ্চিমবাংলায় জন্মেছি। তাও আবার বাঙালি মধ্যবিত্তের ঘরে। ‘সবর্হারা এন্টেনা’ টি কর্ণের কবচ কুন্ডলের মতই মগজে লেপটে থাকে সবসময়। আন্দাজ করলাম যে শঙ্করদা এরপরই ‘খেটে খাওয়া মানুষের’ কথা বলবেন। অতএব আমিই তড়িঘড়ি বললাম, ‘দেখো, আমি কিন্তু সাধারণ মানুষের বিপুল পরিশ্রমকে অস্বীকার করছি না। ইতিহাস গড়ার লড়াইএ তাদের অবদান কিছু কম নয়। কিন্তু কোপার্নিকাস অথবা রবীন্দ্রনাথের একক ‘অবদান’ যে যুগান্তকারি সেটাই বা অস্বীকার করি কি করে?’
শঙ্করদা মুচকি হাসল,’সিপিএম আর কিছু করুক বা না করুক, বাঙালি বুদ্ধিজীবির এই সর্বনাশটা করে দিয়ে গেছে। হালকা একটু ‘প্রোলেতারিয়েত’ ছিটা লাগিয়ে নিজের বক্তব্য চালিয়ে দাও, তাহলেই সাত খুন মাফ। যাকগে। তুই বরং এই বইটা পড়ে দেখ।’
হাওয়ার্ড জিনের ‘পিপল’স হিস্টরি অফ সাইন্স’। শঙ্করদার শান্তিনিকেতনি ঝোলায় কি করে যে দুনিয়ার প্রয়োজনীয় বই গুলো এঁটে যায়, এই রহস্য আজও ভেদ করে উঠতে পারলাম না।
‘আর এই ছেলেটির সাথে কথা বলিস।’ +৮৮০ দিয়ে শুরু একটা লম্বা সংখ্যামালা। দেলওয়ার জাহানের ফোন নাম্বার।
বইটা পড়া হয়নি। প্রথম দু-এক চ্যাপ্টার পড়ে আর এগোতে পারিনি। কিন্তু দেলওয়ারের সাথে আলাপটা জমে গেছে।
ওপার বাংলার কুষ্টিয়া জেলার কৃষক পরিবারের সন্তান দেলওয়ার ২০০১ সালে এসে পৌঁছলেন চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের বন্দর শহর। বাণিজ্যিক রাজধানীও বটে। পাহাড়ে ঘেরা শহরের সীমানা ঘেঁষেই ছোট ছোট গ্রাম। আর অনতিদুরে ভারত মহাসাগর।
বন্দর শহর হিসেবে চট্টগ্রামের খ্যাতি আজকের নয়। আজ থেকে তিনশো বছর আগেও, পর্তুগীজ ব্যাপারিরা পুর্বের চট্টগ্রামকে ‘বড় স্বর্গ’ আর পশ্চিমের সপ্তগ্রাম কে ‘ছোট স্বর্গ’ বলতেন। উত্তরাপথের পণ্য তখন গঙ্গা বেয়ে নেমে আসত দক্ষিণে। উত্তরবঙ্গে গঙ্গার এক ভাগ পদ্মা হয়ে মিশে যেত ব্রহ্মপুত্রে। তারই দক্ষিণে, সমুদ্র উপকুলে, চট্টগ্রাম বন্দর। শ’য়ে শ’য়ে বাণিজ্যতরী ভেসে যেত জাভা, সুমাত্রা, মালয়ে। কেউবা যেত সিংহলে। অথবা আরও পশ্চিমে, আরব সাগরে।
এহেন চট্টগ্রামে এসে পৌঁছলেন, কুষ্ঠিয়ার কৃষক পরিবারের ছেলে দেলওয়ার। ইচ্ছা, ‘কমিউনিকেশন’ নিয়ে পড়বেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
‘পড়তে গিয়ে দেখলাম, অধ্যাপকরা প্রায় সকলে আমেরিকা অথবা ইউরোপের কমিউনিকেশন থিয়োরিগুলো পড়াচ্ছেন। তাদের অজস্র পুঁথিতে, ক্লাস নোটে, কোথাও আমার দেশগাঁয়ের ‘কমিউনিকেশন’-এর কথা নেই। মনটা একটু বিদ্রোহ করে উঠল।
দেশে দেখেছি কৃষককে তার ফসলের সাথে ‘কথা’ বলতে। যেন নিজেরই সন্তানের সাথে কথা বলছেন।
দেখেছি মাঝিকে স্রোতের সাথে কথা বলতে। গাছকে আকাশের সাথে কথা বলতে।
হয়ত শুনতে খানিকটা অদ্ভুতুরে শোনাচ্ছে। কিন্তু গ্রামদেশে এ হামেশাই হয়ে থাকে। মনে মনে জেনে এসেছি এও একরকমের কমিউনিকেশন। অত্যন্ত জীবন্ত কমিউনিকেশন। তবে এর কথা কেন বইপত্রে নেই? এ নিয়ে কি কোনও গবেষণাই হয়নি?’
দেলওয়ার ভাই কথাগুলো অনুত্তেজিত কণ্ঠে বলছিলেন।
এদিকের ইতিহাসও ছুটেছে বিচিত্র গতিতে। উড়িষ্যার নিয়মগিরী পাহাড় কিনে নিতে চাইছে বেদান্ত শিল্প গোষ্টী। পাহাড় কেটে খনি। খনিজ বেচে মুনাফা। শিল্পপতির পক্ষে সরকার আর সান্ত্রীরা। শিল্পপতির পক্ষে আছে আকাশচারী ড্রোণ থেকে মহাকাশচারী স্যাটেলাইট। আর বিপ্রতীপে? চালচুলোহীন কিষাণ, আদিবাসী আর কিছু বেয়ারা ধরণের মানুষজন।
সেই নিয়মগিরীরই কোল ঘেঁষে ‘বসুধা’ কৃষি খামার গড়েছেন কৃষি বিজ্ঞানি অধ্যাপক দেবল দেব। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে থেকে ইন্ডিয়ান রাইস রিসার্চ ইন্সটিট্যুট হয়ে বীরভুম আর নিয়মগিরীর প্রান্তদেশ। অধ্যাপকের যাত্রাপথও কিছু কম চিত্তাকর্ষক নয়। আপাতত বেদান্ত গোষ্ঠীর সাথে আদিবাসী আর কৃষকদের লড়াইএর জমিতেই তিনি ফেঁদে বসেছেন তার কৃষিখামার। এ যেন অগ্নিকুণ্ডে বনসৃজন। কি হবে ‘বসুধা’র? কিই বা হবে নিয়মগিরীর?
বাংলাদেশের পটুয়াখালি জেলার বিচিত্ররঙা ‘ডিঙ্গামণি’ ধান থেকে নিয়মগিরী পাহাড়ের ঢাল তরোয়ালহীন ‘বসুধা’ খামার আর আদিবাসী গ্রাম। আমার সমসময়ের ইতিহাসের এই বিচিত্র গতিপথে কোনো মহামানবের ইঙ্গিত নেই এখনও অবধি। যদিও মানুষ আছে প্রচুর। তাদের কাজ আছে অসংখ্য।
এসব ভাবতে ভাবতেই চুমুক দিচ্ছিলাম গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের কফিতে। আমেরিকার মিলওয়াকি শহরে সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা বাজে। বাইরে এখনো রোদ আছে দিব্যি। হাজার খানেক মাইল দুরে, সুইজারল্যাণ্ড-এর লসেইন শহরে শীলদাও হয়ত কফিতেই চুমুক দিচ্ছে। ‘ম্যানিফোল্ডের ডিফারেনশিয়াল স্ট্রাকচারটাকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছে না বুঝলি। কি করে যে ব্যাপারটাকে বাংলায় বোঝাবো তাই ভাবতে ভাবতে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
(চলবে)