কথা নেই বার্তা নেই, আমেরিকায় নাকি বিপ্লব হবে। সে বিপ্লব হবে ব্যালট বাক্সে। আগে পিছে থাকবে টেলিভিশনের ক্যামেরা। পণ্ডিতেরা তো বলেই দিলেন, একবিংশ শতাব্দিতে ‘রেভোলিউশন উইল বি টেলিভাইসড’।
ভার্মন্ট রাজ্যের সেনেটার বার্ণি স্যান্ডার্সকে ঘিরে গত পরশু অবধিও সেই ‘বিপ্লব’এর উত্তেজনা তুঙ্গে ছিল। বিশেষ করে অল্প বয়েসি ভোটারদের মধ্যে। আমেরিকার ভোটপর্বে এমন ‘বিপ্লব’ ‘বিপ্লব’ রব বোধহয় কখনো ওঠেনি। লাখো মানুষের জমায়েত। পানশালার টিভির পর্দায় বার্ণিকে দেখা গেলে হঠাৎ হঠাৎ উচ্চারিত স্লোগানঃ ‘ফিল দা বার্ন’ (অর্থাৎ কিনা হে বড়লোক রক্তচোষার দল, ছেঁকাটা অনুভব করো)। বছর খানেক আগে স্কটল্যান্ডের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছিল।
সে সময় স্কটল্যান্ডেও এক ঐতিহাসিক গণভোটের তোড়জোড় চলছে। স্কটিশ ন্যাশেনালিস্ট পার্টির নেতৃত্ত্বে স্কটল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন থেকে পৃথক হয়ে যেতে চায়। ভোটের মাধ্যমে ঠিক হবে বেশিরভাগ স্কটিশ জনগণের কি কাম্য। ভোটাভুটির ঠিক আগের সপ্তাহে হাজির হলাম সে দেশে।
গ্লাসগোর একটা পাবে ঢুকেছি। বন্ধু বলেছে, স্কটিশ এইল না খেয়ে দেশে ফিরবি না। স্কটিশ এইল এক বিশেষ ধরণের বিয়ার। আমার যদিও মদ্যপানে বিশেষ আগ্রহ নেই, তবু নতুন বস্তুর প্রতি একটা কৌতুহল থাকেই। বিকেল নাগাদ পানশালায় গিয়ে জমিয়ে বসলাম। লাও দেখি এইল। দেখি কেমন খেতে।
আদ্দেক নামই জানি না। আন্দাজে অর্ডার দিয়ে একটা উঁচু টুলের ওপর বসে পড়লাম। একটু পুরোনো ধাঁচের পানশালা। বেশিরভাগ জনতা একটু বেশি বয়েসি। একদম বুড়োবুড়িরাও আছেন। মনে হয় পাবগুলো এদেশের সান্ধ্য আড্ডার ঠিকানা।
এক দীর্ঘদেহি ভদ্রলোক গীটার বাজিয়ে গান করছেন। অল্ড ল্যাঙ সাইন (যার অনুপ্রেরণায়, এবং সুরে ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ রচিত)ও গাইলেন। উচ্চারণ অন্যধারা, তবু সুর শুনে বেশ পুলক জাগল। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ গান বাজনা চলার পর, হঠাৎ সঙ্গীতের লয় পালটে গেল। ভাষা, উচ্চারণ কিছুই বুঝছি না। কিন্তু মেজাজটা যে পালটে গেছে সেটা বেশ বুঝছি। দেখতে দেখতে পাবের অন্যান্য সবাই গলা মেলালেন। বিশেষ করে বেশি বয়েসের মানুষজন। আস্তে আস্তে বুঝলাম, স্বাধিনতার গান গাইছেন ওরা। ধীরে ধীরে একজন দুজন করে নাচতে শুরু করল। ওই তো বৃদ্ধা নাচছেন তার প্রেমিককে ছুঁয়ে ছুঁয়ে। তার চোখটা ঝিকিয়ে উঠছে উত্তেজনায়। এদিকে আমার পাশের চেয়ারে বসা কৃষ্ণাঙ্গ যুবকও দুলে উঠছেন তার সহচরের হাত ধরে। এক অব্যক্ত উষ্ণতা অকস্মাত ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পাবটায়।
সে যাত্রা ভোটে বেশিরভাগ স্কটিশ নাগরিক ‘স্বাধিনতা’র বিপক্ষে ভোট দেয়। স্কটল্যান্ড এখনো গ্রেট ব্রিটেনেরই অংশ।
২০১৬-য় বার্নি স্যান্ডার্সও, আমেরিকায় ‘বিপ্লব’ আনতে পারবেন না।
ভোট যত এগোচ্ছে, সহজ অঙ্কের হিসেবেই তার প্রতিদ্বন্দী হিলারি ক্লিন্টন অনেকটাই এগিয়ে থাকছেন। তবু অঘটন একটা ঘটেছেই। একজন স্বঘোষিত সোশালিস্ট খোদ আমেরিকার বুকে যে পনেরোটা রাজ্যের ভোটে জিতে গেছেন! আজ থেকে বিশ বছর আগেও এটা অকল্পনীয় ছিল।
হিলারি আপাতত জিতেছেন উনিশটা রাজ্য। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী সম্ভবত তিনিই হবেন। ২০১৬-র ভোটপর্বে মার্কিণদেশের যুবক যুবতীদের, শ্রমজীবি মানুষের ফের ধোঁকা খাওয়ার পালা। এযাত্রা ‘বিপ্লব’ আর হল না। ২০০৮-এ বারাক ওবামাও ক্ষমতায় এসেছিলেন ‘পরিবর্তন’এর স্বপ্ন দেখিয়ে। সে যাত্রাও বরাতে ধোঁকাই জুটেছিল। ওবামার শাসনকালে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়া থেকে সিরিয়া অবধি বোমাবাজি করেছে, তেলের জন্য, বড় বড় কর্পোরেশনের স্বার্থে আইন পালটেছে। যে পুঁজিপতিদের লোভের জন্যে গোটা পৃথিবীটাই অর্থনৈতিক মন্দায় চলে গেছিল, ২০০৭-০৮ সালে, তাদের একজনও গ্রেপ্তার হননি। বরং সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় সেই সব কর্পোরেশনদেরই হাত শক্ত করা হয়েছে।
‘বিপ্লব’ বল, বা ‘পরিবর্তন’। ভোটের মাধ্যমে হতে পারে কি? মার্কিণদেশের সিংহভাগ জনগণ সে আস্থা হারিয়েছেন বহুকাল। ভোটে তাদের অংশগ্রহণও কমে গেছে বছর বছর।
এদিকে ভোটের মরসুম স্বদেশেও। পশ্চিমবাংলার খবর রাখি যে ভাবে পারি। ‘আনন্দবাজার’ আর ‘এই সময়’ পড়ি আন্তর্জালে। যে বন্ধুরা গণআন্দোলনের সাথে যুক্ত তাদের থেকেও খবর মেলে। দেশে নাকি লুম্পেনরাজ চলছে। তেত্রিশ ভাগ ভারতবর্ষ খরার মুখোমুখি। চা বাগানে চলছে অনাহারে মৃত্যুর মিছিল। গাঙ্গেয় উপত্যকায় জলের হাহাকার হয়ত নেই, কিন্তু চলছে মাৎসান্যায়। বালি সিমেন্টের সর্দাররা, জেলায় জেলায় গুণ্ডারাজ চালাচ্ছে। যারা আগে সিপিএম-এর হয়ে মানুষ মারত, রিগিং করত, তারা জমিয়ে বসেছে তৃণমুলে। চল্লিশ ডিগ্রী তাপমাত্রা, ভুমিকম্প, উড়ালপুল ভেঙে পড়া – এ সব চলছে তারই পাশাপাশি। সবমিলিয়ে একটা দুঃসময়ের ছবিই দেখতে পাই।
কিন্তু মন মানে না। গণিত করতে গিয়ে শিখেছি, চট করে যা সত্যি মনে হয়, তলিয়ে দেখলে তা হয়ত সত্যি নাও হতে পারে। এই খুঁতখুঁতানি থেকেই শুরু হয়েছে খোঁজখবর। আর নিতান্ত হঠাৎই আলাপ হয়েছে দেলওয়ার জাহানের সাথে।
(চলবে)