দলের ওপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য সংক্রমিত হয়েছে সরকার পরিচালনায়। এই মমতাশাহি দেখলে ছাত্রজীবনে দেখা ইতিহাসের মাস্টারমশাই নির্ঘাত বলতেন ‘দি অ্যাবসোলিউট মনার্কি অব বেঙ্গল’।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
Anandabazar Patrika, 19th April 2016
বিপুল জনসমর্থন নিয়ে যে দল শাসনক্ষমতায় আসে, তার কাছে মানুষের প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকে। বিশেষ করে সেই দল যদি দীর্ঘদিন ধরে শাসনে কায়েম থাকা এক ক্ষমতাতন্ত্রকে উলটে দিয়ে নতুন সরকার গঠন করে। সুতরাং, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের কাছে পশ্চিমবাংলার মানুষের প্রত্যাশার বহরটা যে বেশ বড়সড় ছিল, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। পাঁচ বছর বাদে পুনর্নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে তৃণমূল সরকারের সাফল্যের ঘোষণাতে যে বেশ কিছুটা বাড়াবাড়ি আছে, তাতেও অবাক হচ্ছি না। কিন্তু এই আতিশয্যের দিকগুলো মনে রেখেই তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের একটা নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করা সম্ভব।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যশাসনের প্রধান রণকৌশল হল জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে সামান্য হলেও কিছু-না-কিছু পরিষেবা অথবা সুযোগ পৌঁছে দেওয়া, যার ফলে মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারণে খানিকটা সুবিধা হয়। তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহারে দেখলাম, রাজ্যের ৯০ শতাংশ মানুষই নাকি এখন কোনও-না-কোনও সরকারি পরিষেবা প্রকল্পের উপভোক্তা। শতাংশের হিসেব নিয়ে তর্ক না করেও বলা যায় যে, ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজ সাথী’, ‘শিক্ষাশ্রী’ ইত্যাদি প্রকল্পে বহু স্বল্পবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা উপকৃত হয়েছে। জঙ্গলমহল এলাকার বিশেষ প্রকল্পে রাস্তা আর সেতু নির্মাণে উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। সেখানকার অধিকাংশ মানুষ এখন দু’টাকা কিলো দামে চাল পান। এলাকার অনেককে পুলিশ আর হোমগার্ডে চাকরি দেওয়া হয়েছে। এর পিছনে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থসাহায্য ছিল নিশ্চয়। তার ওপর জনকল্যাণ ছাড়া এই মাওবাদী আন্দোলনের অঞ্চলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করার তাগিদও ছিল।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমর্থন নিশ্চিত করাটাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রণকৌশলের একটা অপরিহার্য অঙ্গ। বিভিন্ন মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ওবিসি তালিকাভুক্ত করার কাজ বামফ্রন্ট সরকারের শেষ পর্বে শুরু হয়েছিল। শোনা যায়, পশ্চিমবাংলার ৯৭ শতাংশ মুসলিম এখন ওবিসি সংরক্ষণের সুযোগ নিতে পারেন। মুসলিম ধর্মপ্রতিষ্ঠান আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সরকারি সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ উৎসাহ দেখিয়েছেন। তাতে অনেক সময় রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতা লঙ্ঘিত হয়েছে এমন আপত্তি উঠেছে, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কান দেননি। গত পাঁচ বছরে পশ্চিমবাংলায় সাম্প্রদায়িক শান্তি ক্ষুণ্ণ হয়নি। পাহাড়ে গোর্খা জনমোর্চার দাপট কমানোর উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী লেপচা, তামাং, শেরপা, ভুটিয়া প্রভৃতি জনজাতির জন্য আলাদা আলাদা উন্নয়ন বোর্ড তৈরি করেছেন। এর ফলে পাহাড়ের শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে, না কি নতুন এক বিভাজনের রাজনীতির সূত্রপাত হল, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
তৃণমূল সরকারের অর্থ দফতর কর ব্যবস্থার সংস্কার করে কর আদায় অনেকটা বাড়িয়েছে, এ কথা সত্যি। কিন্তু অন্য দিকে খরচের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে বামফ্রন্ট সরকারের রেখে যাওয়া ঋণের ওপর বিপুল পরিমাণ নতুন ঋণ জমেছে প্রতি বছর। নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে অনেক। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, হাসপাতাল, পলিটেকনিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উদ্দেশ্য সাধু। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থবরাদ্দ আর পরিকাঠামো ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকুও অর্জন করতে পারছে না। কৃষিতে অবনতির ধারা অব্যাহত। কিসান মান্ডি প্রভৃতি সরকারি প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফড়ে আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাপট অপ্রতিহত। আজকের বাংলার কৃষকের ঋণগ্রস্ত চেহারা সেই ব্রিটিশ আমলের কথা মনে করিয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর সাধারণ কৃষকের এমন দুর্দশা কখনও হয়নি।
শিল্পোৎপাদনে উন্নতি নিয়ে তৃণমূল সরকারের তরফে অনেক উদ্ভট দাবি করা হয়েছে। সেগুলো নিয়ে কথা খরচ করার মানে হয় না। পশ্চিমবঙ্গে যা ঘটে চলেছে, তা হল অসংগঠিত শিল্পের দ্রুত প্রসার। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পুঁজি সম্বল করে, পরিবারের সকলকে নিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে, পুলিশের ঘুষ আর ঝান্ডাধারীদের তোলা চুকিয়ে দারিদ্র সীমার আশেপাশে কোনও ক্রমে বেঁচে আছে অধিকাংশ মানুষ। হকারি, চায়ের দোকান, রিকশা বা অটো চালানো, শহরের মধ্যবিত্ত বাড়ির ঠিকে কাজ, সেখান থেকে শুরু করে নানা বিচিত্র জীবিকা খুঁজে বের করে তথাকথিত অসংগঠিত শিল্পের শ্রমিক-মালিকরা জীবনধারণ করছে, সুযোগ পেলেই চলে যাচ্ছে ভিনরাজ্যে কাজের খোঁজে। সরকারের দাবি যে, পশ্চিমবাংলার সর্বনাশা ‘বন্ধ কালচার’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বন্ধ করে দিয়েছেন। সরকার-বিরোধী বন্ধের ওপর কড়াকড়ি হয়েছে বটে, কিন্তু প্রয়োজন হলে সরকার-সমর্থিত বন্ধ যে হবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।
সংগঠিত শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান নেই। তাই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভরশীল জীবিকার প্রসার বেড়ে চলেছে। দালালি, ঠিকেদারি থেকে সিন্ডিকেটের অসংগঠিত ব্যবসা বামফ্রন্ট আমলেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক শৃঙ্খলার জোরে আইন ভাঙা আর জুলুমবাজিতে রাশ টেনে ধরা সম্ভব ছিল। ব্যাপারটা পার্টি নেতাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বাইরে চলে যায়নি। তৃণমূল আমলে দেখা গেল, রাজনীতি-নির্ভর ব্যবসা বা জীবিকার ওপর কোনও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই— না দলীয় নেতৃত্বের, না প্রশাসনের, না পুলিশের। এক জন দাপুটে তৃণমূল নেতা তো সে দিন স্পষ্ট বললেন, সিন্ডিকেটের ব্যবসা বন্ধ করার চেষ্টা করলে সরকার উলটে যাবে। এমনিতেই নির্মাণ ব্যবসায় কালো টাকার ছড়াছড়ি, তার ওপর এই রাজ্যে আর কোনও শিল্পবিনিয়োগ না হওয়ায় রিয়াল এস্টেট ব্যবসাতেই টাকা খেটেছে সবচেয়ে বেশি। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে পশ্চিমবাংলার শহর, আধা-শহর অঞ্চলে এক ধরনের জঙ্গল রাজ সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে এলাকা দখল নিয়ে খুনোখুনি থেকে শুরু করে ডাকাতি, নারীধর্ষণ, বেআইনি পানশালা, মাদকের কারবার, বেপরোয়া গাড়ি বা বাইক চালানো— সব রকম অপরাধ ঘটে চলেছে পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায়। কারও কিছু বলার উপায় নেই। রাজ্যের কোষাগার শূন্য হওয়া সত্ত্বেও যে শ’য়ে শ’য়ে ক্লাবকে দেদার টাকা বিলোনো হচ্ছে আর যে কোনও উপলক্ষে উৎসব-মহোৎসবের আয়োজন হচ্ছে, তাকেও এই রাজনীতি-নির্ভর কর্মসংস্থানের পন্থা হিসেবে দেখতে হবে। এ হল এক রকম হিসাব-বহির্ভূত বেকার ভাতা, যার বিনিময়ে উপভোক্তাদের তৃণমূল দলের লস্কর বাহিনীতে যোগ দিতে হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক কর্মপদ্ধতির কিছু অভিনব দিক আছে। তিনি সরকারি দফতরের কর্তাব্যক্তিদের মহাকরণে (ইদানীং নবান্ন’য়) আটকে না রেখে জেলায় জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক করেন। সেখানে সাধারণ মানুষের সভা ডেকে দফতরের সচিব বা অন্য শীর্ষস্থানীয় আমলাদের কাজের কৈফিয়ত তলব করেন। দরকার মতো প্রশংসা অথবা তিরস্কার করেন। এর ফলে যে আনুষ্ঠানিক অর্থে প্রশাসনকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে আসা গেছে, তাতে সন্দেহ নেই। তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারের দাবি, এতে প্রশাসনের দায়বদ্ধতা বেড়েছে, কাজে গতি এসেছে। কিন্তু এর অন্য দিক হল, সরকারি কাজের এক অভূতপূর্ব কেন্দ্রীকরণ। প্রশাসনিক কাঠামোর স্তর অনুযায়ী দায়িত্ব আর দায়বদ্ধতা ভাগ করে দেওয়া নেই, কে কার কাজের হিসেব নেবে তার কোনও নির্দিষ্ট ছক নেই। কারণ, এক জনের প্রশংসা বা নিন্দাই সব, আর কারও মতামতের কোনও গুরুত্ব নেই। প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্রীকরণের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, স্থানীয় কাজের দায়িত্বে থাকা বিডিও-দের কাজের তদারকি করছেন পঞ্চায়েত নয়, সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রী বা সচিব নয়, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। শুধু যে চূড়ান্ত প্রশাসনিক কেন্দ্রীকরণ হয়েছে তা-ই নয়, যে কাজগুলো পঞ্চায়েতের করার কথা বা করা উচিত ছিল, সেই কাজও বহুলাংশে সরকারি প্রশাসন অর্থাৎ বিডিও-এসডিও-ডিএমের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। যুক্তি হল, পঞ্চায়েতের কাজে দক্ষতার অভাব থাকে, দুর্নীতির সম্ভবনাও থাকে। মুখ্যমন্ত্রী সর্বত্র ঘুরে বেড়ান। কোথায় মানুষের কী প্রয়োজন, তার সব খবর তিনি রাখেন। তাই সরাসরি তাঁর তদারকিতেই উন্নয়নের কাজ সবচেয়ে দ্রুত আর দক্ষ ভাবে সম্পন্ন হতে পারে। এর ফলে কিন্তু পঞ্চায়েতি রাজের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের যে প্রক্রিয়া সারা দেশে শুরু হয়েছিল, তাকে আমল দেওয়া হল না। গ্রামের মানুষ তাঁদের স্থানীয় প্রয়োজন অনুসারে, নিজেদের সিদ্ধান্তে, নিজেদের দায়িত্বে উন্নয়নের কাজ করবে, এমন ভাবা হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে তার বদলে জনগণকে বলা হচ্ছে— মুখ্যমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখো, তিনি তাঁর নিজের প্রশাসনের লোকেদের দিয়ে তোমাদের প্রয়োজন মিটিয়ে দেবেন। যেখানে গণতান্ত্রিক অধিকারের মাধ্যমে জনগণের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার কথা ছিল, সেখানে এক সার্বিক পরনির্ভরতা গোটা রাজ্যকে গ্রাস করেছে।
এর মূলে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস দলের ওপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একচ্ছত্র আধিপত্য, যা সংক্রমিত হয়েছে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে। তিনিই সর্বেসর্বা। শুধু নেত্রী নন, সার্বভৌম ক্ষমতার একক দাবিদার। আমাদের ছাত্রজীবনে দেখা ইতিহাসের মাস্টারমশাই আজ থাকলে নির্ঘাত বলতেন ‘দি অ্যাবসোলিউট মনার্কি অব বেঙ্গল’। একমাত্র নির্বাচনের অনুষ্ঠানটুকু ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে আজ প্রজাতন্ত্র নেই, আছে অবিমিশ্র রাজতন্ত্র। ব্যাপক গণতন্ত্রের যুগে এমন রাজতন্ত্রের উদ্ভব হল কী ভাবে? হল, কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও রাজবংশে জন্মাননি। সাধারণ পরিবারে জন্মে তিনি কঠিন লড়াই করে আজ ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছেন। তাতেই প্রমাণ হয় তাঁর অসাধারণ, প্রায় অলৌকিক, ব্যক্তিগত শক্তি। সেই শক্তি তিনি প্রয়োগ করেন মানুষের ভাল করার জন্য। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম তাঁর কাছে বিড়ম্বনা। এই আমলাতন্ত্রের নিয়ম দেখিয়ে ক্ষমতাবানেরা এত দিন সমস্ত সরকারি সুযোগসুবিধা কুক্ষিগত করে রেখেছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে সরকারি সম্পদ সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করছেন। তাঁর উদ্দেশ্য যে মহৎ, তা সন্দেহাতীত, তাই তাঁর পন্থা নিয়ে কূটকচাল মন্দলোকের চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। মমতার ক্ষমতাকে নিয়ম দিয়ে বেঁধে রাখা অনুচিত। তাঁর কল্যাণকামী স্বৈরাচারই জনগণ চায়, কারণ তাতেই তারা উপকৃত হচ্ছে। শুনছেন না, মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনী সভায় ঘোষণা করছেন, ‘তৃণমূলের কোনও আলাদা প্রার্থী নেই। সব কেন্দ্রে আমিই প্রার্থী’?
মমতার সমর্থকেরা এমন কথাই বলে থাকেন। শুধু বলেন না, স্বৈরাচারী শাসনের প্রতিটি আচার-আচরণ তাঁরা সমর্থন করেন, সোৎসাহে তাতে অংশ নেন। এমনকী ঘুষ নেওয়ার জ্বলজ্বলে প্রমাণ চোখের সামনে দেখেও তাঁরা বলেন, ‘এই যে নির্বাচন, যাকে সবাই বলে গণতন্ত্রের উৎসব, পার্টিরা তার খরচ মেটায় কী করে বলুন তো? বড় বড় সর্বভারতীয় পার্টিরা বড় বড় বিজনেস হাউসের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা পায়, তার খবর কেউ জানতে পারে? শুধু তৃণমূলের বেলাতেই চিট ফান্ড আর সিন্ডিকেট নিয়ে যত ভুরু কোঁচকানো। ও-সবে মমতার ভাবমূর্তিতে এতটুকু চিড় ধরবে না।’ স্তাবকতাতেই তাঁরা থেমে থাকেন না, স্বৈরাচারের অনিবার্য লক্ষণ সেই পছন্দসই ও নির্ভরযোগ্য লোকের বাছাই করা তালিকাতে জায়গা পাওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে শুধু তৃণমূল দল নয়, সমগ্র প্রশাসন ব্যবস্থাই আজ জো-হুজুরে পরিপূর্ণ। তাই মুখ্যমন্ত্রী সদর্পে বলতে পারেন ‘এরা সবাই আমার অফিসার’।
এই অবক্ষয়ের শিকড় খুঁজতে হলে বামফ্রন্ট আমলে ফিরে যেতে হবে নিশ্চয়। কিন্তু দলতন্ত্র আর স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রে পার্থক্য আছে। দলতন্ত্রে নিজস্ব নিয়মের বাঁধন থাকে, খামখেয়ালি বরদাস্ত করা হয় না, বরং শৃঙ্খলার নিগড় হয়তো বেশি রকম আঁটোসাঁটো। স্বৈরতন্ত্রে আকস্মিকতা আর খামখেয়ালই প্রত্যাশিত। আজ সবাই যাঁকে মুখ্যমন্ত্রীর ডান হাত বলে জানে, সেই অতি বিশ্বস্ত মহাসচিব হঠাৎ এক দিন সন্দেহভাজন হয়ে বিতাড়িত হলেন। রাজতন্ত্রের অমোঘ নিয়মে দায়িত্ব পেলেন ভাইপো। মমতাশাহির বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। কিছু দিন বাদে আবার ভোটের মুখে দল সামলানোর সেই বিতাড়িত ডান হাত ফিরে এলেন। ক্ষমতার শীর্ষে যখন নেত্রীর নেকনজর নিয়ে এমন চরম অনিশ্চয়তা, তখন প্রশাসনের আর সব কর্তাব্যক্তিরা যে লোভ সংবরণ করে, নির্ভয়ে, আত্মসম্মান বজায় রেখে নিয়মানুবর্তী হবেন, সে জন্য বোধহয় বিশেষ চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রয়োজন। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে তেমন চরিত্রগুণ বড় একটা দেখা যাচ্ছে না। তৃণমূল শাসনের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক ক্ষতি হল ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয়, যার সংশোধন দুঃসাধ্য।
অনেককে বলতে শুনি, ‘ও সব কেতাবি তত্ত্ব রাখুন মশাই, এটাই আজ বাস্তব। বেশি নিয়ম দেখাতে গেলে পাঠিয়ে দেবে জঙ্গলমহল, অথবা মিথ্যে অভিযোগে ফাঁসিয়ে সাসপেন্ড করে দেবে। দেখলেন না, অমুকের কী হল?’ অথচ যিনি বলছেন, তিনিও এক কালে শিখেছিলেন যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে পেশাদার বিশেষজ্ঞের স্বাধীনতা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবেই গড়ে উঠেছিল আমলাতন্ত্র আর শিক্ষক, বৈজ্ঞানিক, আইনজীবী, চিকিৎসক ইত্যাদি পেশার নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতি। শাসক ইংরেজের সমকক্ষ হওয়ার জেদ থেকে বহু চোখ রাঙানি আর শাস্তি সহ্য করে গত দেড়শো বছর ধরে এই সব প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিল শিক্ষিত বাঙালি সমাজ। আজ সমূহ ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে সাধারণ ভোটদাতার অজ্ঞানতা বা অপরিণামদর্শিতাকে দোষ দিলে নিজেকে ঠকানো হবে। প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর দায় সাধারণ ভোটদাতার নয়, তার সে সুযোগও নেই। প্রতিষ্ঠান রক্ষার প্রধান দায়িত্ব সেই সব দফতর, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, আদালত যাঁরা চালান, তাঁদের, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী শিক্ষিত সমাজের সদস্যদের। তাঁরা যে জ্ঞানপাপী হয়ে আশু সুযোগসুবিধার লোভে অথবা অন্যায় শাস্তির ভয়ে স্বৈরতন্ত্রের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেবেন না, সে জন্য তাঁরা বৃহত্তর সমাজের কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। আজ কি তাঁরা সেই প্রতিশ্রুতি রাখবেন?
সমাজবিজ্ঞানী, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ সাম্মানিক অধ্যাপক
ei lekhata amaro bhalo legechhilo.
LikeLiked by 1 person