ফিরোজা বেলা বারোটায় মেসেজ পাঠালো ‘কেনিলওয়ার্থ পিপস’ এ।
‘এস ও এস! এমারজেন্সি! কেউ একটা উত্তর দাও।’
রবিবারের সকাল। সবাই মোটামুটি ঘরেই ছিল। ‘কেনিলওয়ার্থ পিপস’ আমাদের আড্ডা-গ্রুপের নাম। যে কেউ বাকি সকলকে একসাথে মেসেজ পাঠাতে পারি। ফোনে তেমন ভাবেই ফিট করা আছে নাম আর নাম্বার। এ আমাদের পাঁচমুর্তির রোয়াক। ভারতের চারজন আর পাকিস্তানের এক।
আমি তড়িঘড়ি উত্তর দিলাম, ‘কি হয়েছে? কি ব্যাপার?’
‘একবার তোমার ঘরে আসতে পারি?’
‘অবশ্যই!’
‘আর শোনো, বাকিদেরও ফোন করে আসতে বলো।’
আমরা একই ফ্লোরে থাকি। উল্টোদিকের করিডরে ফিরোজার ফ্ল্যাট। কলকাতার ছেলে সন্দীপ ঠিক পাশের ফ্ল্যাটেই থাকে। উড়িষ্যার স্বপন আর মহারাষ্ট্রের অদিতি অবশ্য আমাদের ফ্লোরে থাকেনা। ওদের আসতে একটু সময় লাগল।
কি হয়েছে? কি বৃত্তান্ত?
ফিরোজা প্রায় ম্যাজিকের মত চাদরের আড়াল থেকে বাটিটা বার করল।
‘আজ সকালে তন্দুরি চিকেন রাঁধলাম! সকলের জন্য এনেছি!’
‘আরে তুমি বললে যে এমারজেন্সি! আমরা তো ঘাবড়েই গেছিলাম।’
ফিরোজা তখন মুচকি মুচকি হাসছে, ‘তন্দুরি চিকেনের চেয়ে বেশি এমারজেন্সি কি হতে পারে।’
এক্কেবারে হক কথা। আমরা কালবিলম্ব না করে হামলে পড়লাম। সপ্তাহান্তে আমার ঘরে প্রায়ই মোচ্ছব বসে। গতকাল সন্দীপ রেঁধেছে চিংড়ী মাছের মালাইকারি (বাজার ঢুঁড়ে নারকোলের দুধ জোগাড় করেছি)। ফিরোজা এক বিশেষ ধরণের পাকিস্তানি ডাল আর ফ্রায়েড রাইস রেঁধেছে। আমি অবশ্যই শিক্ষানবিশী করছি মন দিয়ে। স্বপন আর অদিতিও ভলান্টিয়ারি করেছে। কেটে বেটে একসাথে মিলে রান্না। তারপরে এক্কেবারে দেশি স্টাইলে মাটিতে বসে ভোজন।
দেশে থাকতেও এমনটা হত। গড়িয়ার কাছে এক ছোট্ট মত বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলাম বছরখানেকের জন্য। মাঝে মাঝেই রাত বিরেতে বাই উঠত আমাদের। সৌত্রিক-পত্রালিকা থাকলে তো কথাই নেই। প্রেমিক প্রেমিকা যুগলে রেঁধে মাত করে দিত। বাজার করতাম মানিকতলার থেকে। এক্কেবারে রসিয়ে। এছাড়া বাকিদের ভলান্টিয়ারি তো আছেই। রাত ভোর আড্ডা, সিনেমা দেখা, গান। এছাড়া চার চাকা হাঁকিয়ে রুপনারায়ণ কি মাতলা নদীর তীর।
গভীর রাত্রে কখনো রুপনারায়ণের তীরে বসেছ?
নিথর হয়ে শুয়ে আছে সার সার জেলে ডিঙি। বেশ অনেকটা দুরে কোলাঘাটের ব্রিজে সারী সারী আলো। নিস্তব্ধতার চূর্ণ করে থেকে থেকে ট্রেন যাচ্ছে ব্রিজ দিয়ে। ডান হাতে ওই বিশাল জাহাজের মত ওটা কি? অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না ভাল করে।
নদী শান্ত। বহু পথ পেরিয়ে সে সমুদ্রের কাছে চলে এসেছে প্রায়।
নদীর তীরে কতক্ষণ বসে আছ তুমি? আকাশে কি চাঁদ আছে? শান্ত জলের ওপর হালকা রুপোলি রেখার ছলাৎ ছলাৎ। তুমি নিস্তব্ধতা পূর্ণ করা কোনও গান শুনছ। তোমার বন্ধু শোনাচ্ছে। সুমনের গান। বয়েসকালের কন্ঠ। ‘এই প্রেমহীন সময়ে বলছি তোমায় ভালবাসি, এই অন্ধকারেই চল জোনাকিকে সাথে নিয়ে আসি …’। প্রথমবার গানটা শুনেছিলাম রুপনারায়ণের তীরে। গভির রাতে। বন্ধু শুনিয়েছিল।
আজ পূর্ণ চন্দ্র গ্রহণ। মিশিগান হ্রদের ওপর চাঁদের আলো ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল। একটু একটু করে পৃথিবীর আঁধার চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে। গ্রহণ দেখবে বলেই হ্রদের তীরে এসেছে বন্ধুরা। জেনিফারের সাথে আলাপ হয়েছে পথেই।
‘আমার মহাকাশ নিয়ে খুব আগ্রহ। তাই এসেছি। তুমি?’
আমি একটু চুপ করে রইলাম। মহাকাশ নিয়ে আগ্রহ হয়ত আমারও আছে। তবে আজ যাচ্ছি সেই ফেলে আসা রুপনারায়ণের টানে। কেমন করে চাঁদের আলো পিছলে যায় জলে, তাই আবারও দেখব বলে। আমার ঘর থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট দুরে মিশিগান হ্রদ। আমার ঘর থেকে রুপনারায়ণ কত সহস্র ক্রোশ।
জেনিফার আমাদের দলে জুটে গেল। হ্রদের তীরে বোল্ডার ফেলা আছে। আমরা তারই ওপরে বসলাম। ভাল ঢেউ আছে। জল রীতিমত পাথরের গায়ে আছরে পড়ছে। ‘গলায় তেমন সুর খেলে না’ তবু আপনা থেকেই ‘আকাশ ভরা সূর্য্য তারা’য় আমি আর সন্দীপ গলা মেলালাম।
চিত হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম কত দিন পর। তারারা মিট মিট করে। গ্রহরা করে না। ছেলেবেলায় পড়েছিলাম।
অভ্যাস বশতঃ আকাশে কালপুরুষ নক্ষত্রমালাকে খুঁজতে গিয়ে থমকালাম। একি কালপুরুষ কই? এদিকে চাঁদ ক্রমশ আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে। সপ্তর্ষিমণ্ডল পর্য্যন্ত জ্বলজ্বল করে উঠেছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও কালপুরুষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ খোঁজ। ইন্টারনেট ঢুঁড়ে মালুম হল যে এ সময়ে পৃথিবীর এই জায়গায় কালপুরুষ দেখা যায় না। আকাশটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করল। হাজার হোক মগজ অভ্যাসের দাস। ততক্ষণে চাঁদ প্রায় অদৃশ্য। একটা রক্তিম ছোপ গাঢ় অন্ধকারের গায়ে লেপটে আছে। বিজ্ঞানীরা বলবেন কেন আজকের চন্দ্রগ্রহণে, চন্দ্রমা লোহিতবর্ণ। তারা বলবেন কি ভাবে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল সূর্য্যের আলোর নীল রঙকে শুষে নিয়ে শুধু লাল রঙকেই চাঁদ অবধি পৌঁছতে দিচ্ছে। তাও সে সরাসরী পৌঁছতে পারছে না। পৃথিবী পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। অতএব বায়ুমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে পিছলে পিছলে সূর্যালোকের লালরঙটুকু অতিকষ্টে পৌঁছাচ্ছে চাঁদ অবধি। আর তাই ঠিকরে ফিরছে আমাদের চোখে।
এরকম চন্দ্রগ্রহণ বড় একটা হয় না। এর আগে হয়েছিল ১৯৮২ সালে। ফের হবে ২০৩৩ এ। চাঁদ পৃথিবীর চারপাশে ঠিক গোলপথে ঘোরে না। পথটা খানিকটা ডিম্বাকৃতি। অতএব সে কখনো থাকে পৃথিবীর কাছা কাছি। কখনো অপেক্ষাকৃত দুরে। চাঁদ নাকি পৃথিবীর খুব কাছাকাছি চলে এসেছে আজ। শুধু তাই নয়, পৃথিবী, চাঁদ আর সূর্য্য নাকি একই সমতলে এসেছে অনেকদিন পরে। অর্থাৎ কিনা যদি মহাশুণ্যে এমন একটা কার্পেট বিছাই যার উপর পৃথিবী আর সূর্য্য ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহলে আজকের দিনে চাঁদও সেই কার্পেটের ওপর অবস্থান করবে। ফলত চন্দ্রগ্রহণ হবে আরো জম্পেশ।
গ্রহণ হয়েছে রাত ন’টা দশ নাগাদ। বন্ধুদের বললাম যে একটু কাজ আছে তাই আগে বেরিয়ে যাচ্ছি। সত্যিই কাজ ছিল। মিথ্যে বলিনি।
পাকদণ্ডি বেয়ে কংক্রিটের রাস্তাটা উঠে গেছে। রুপনারায়ণের তীর ঘেঁষে কাঁচা পথটায় অনেকদিন খোয়া পড়েনি। রাস্তায় গাড়ির স্রোত থামাতে গেলে বোতাম টিপতে হবে। বোতাম টিপলে গাড়ির থেমে যাবে। পথচারি রাস্তা পার হতে পারবে। রাস্তা পেরোলেই মন্টুর চায়ের দোকান। ভোর ভোর সে জল চাপিয়েছে। কোলাঘাট স্টেশনে কাকডাকা ভোরেই ভীড়। শহর গ্রাম ঝেঁটিয়ে সবাই কলকাতা যাবে চাকরির ফিকিরে। গাড়ির স্রোত থামিয়ে বিরাট ক্যাথিড্রালটার সামনে দিয়ে হাঁটছি। ডান হাতে একটা হাসপাতাল। ঘাসে ছাওয়া লনের মাঝখানে ফালি ফালি কংক্রিটের পথ। চা’টা বেশ হয়েছে। দুটো বিস্কুট নিয়ে নিলাম। জেলেরা কখন ঘরে ফিরবে? আমরা ইলিশ কিনতে এসেছি। বন্ধু দুজন বলল, ‘অশনি তবে একটা কবিতা পড়ে শোনাও’। লিফটের বোতাম টিপলাম। পাঁচ। কেন যেন খুব তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে হবে। কালপুরুষ হারিয়ে গেছে।