যুদ্ধ (অচিন দেশের ৬)

যুদ্ধ (অচিন দেশে – ৬)

অত্রি ভীড়ের মধ্যে হতভম্ব দাঁড়িয়ে ছিল। চতুর্দিকে ততক্ষণে বিশৃঙ্খলা চরমে উঠেছে। সামনের দিকে থেকে অসহ্য গোলমালটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। তৃণার শরীরটা হঠাৎ ছিটকে পেছনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ‘পুলিশ বেধরক লাঠি চালাচ্ছে। আমাদের সামনের দিকে এগোতে হবে।’ ও হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়াল।

অত্রি জানে তৃণার এজমা আছে। সামনের দিকে প্রায় দু ডজন সাদা পোষাকের পুলিশ ততক্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সৌম্যব্রত আর দেবলীনাকে দুজন পুলিশ হ্যাঁচরাতে হ্যাঁচরাতে ভ্যানে তুলে ফেলল। অত্রির সর্বাঙ্গ ঠান্ডা হয়ে আসছে। সমস্ত মন ঝনঝন করছে। সে কি এতটাই ভীতু! ঐ তো তৃণা প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ওই যে তুহিন ব্যারিকেড আঁকড়ে বসে পড়েছে। ওর ওপরে লাথি ঘুষির বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। কতক্ষণ পারবে তুহিন?
হঠাৎ অত্রির চোখে পড়ল দশ মিটার দুরের পুলিশের গাড়িতে। অধিরাজ সরকার না? অধিরাজের সন্তানকে অত্রি পড়াতে যেত প্রতি সপ্তাহে দুবার, আধঘণ্টা লোকাল ট্রেন ঠেঙিয়ে। অত্যন্তু সুভদ্র অধিরাজ সরকার যে পুলিশের বড়কর্তা তা অত্রি কাজ করতে করতে জেনেছিল। ভদ্রলোকের সাথে এর আগে বার পাঁচেক ওর সরাসরী কথা হয়েছে। প্রথম দিকে সাহিত্য, সঙ্গীত ইত্যাদী নির্দোষ বিষয়ে কথা হত। শেষ দুবার অত্রি নিজের দরকারে ওনার কাছে সাহায্য চাইতে গেছিল। খানিকটা কাজও হয়েছে।
আজ কি তবে অধিরাজের বিরুদ্ধে ওকে হাত ওঠাতে হবে?


অর্জুন বললেন, মধুসূদন পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণকে আমি কি করে শরাঘাত করব? মহানুভব গুরুজনকে হত্যা করা অপেক্কা ভিক্ষান্ন ভোজন করাও শ্রেয় … আমি বিজয় চাই না, যাঁদের জন্য লোকে রাজ্য ও সুখ কামনা করে তাঁরাই যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দিতে এসেছেন।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।।

গোয়েঙ্কাদের বাংলা লুঠের বিরুদ্ধে আজকের মিছিল। বন্ধুরা দীর্ঘ দিন ধরে অনশন করে তাদের শরীর বাজি ধরেছে সরকার বিরুদ্ধে এই লড়াইএ। কলকাতা তথা পশ্চিমবাংলায় বিদ্যুৎএর দাম সমস্ত ভারতের তুলনায় বেশি। শহরের চল্লিশ লাখ মানুষ থাকে বস্তি অঞ্চলে। দিন আনি দিন খাই মানুষের রক্ত জল করা পয়সা, প্রতিমাসে গোয়েঙ্কারা বিদ্যুৎএর দামের নামে শুষে নিচ্ছে। ছ মাস অন্তর অন্তর দাম বাড়াতে বাড়াতে বিদুৎএর মাশুল আকাশ ছুঁয়েছে। সিপিএম অথবা তৃণমুল , সরকার থেকে বিরোধী, সবপক্ষকে সিইএসসির মালিক সঞ্জীব গোয়েঙ্কা পকেটে পুরে রেখেছে। বাম জমানায় হোক বা মা মাটি মানুষের জমানা, সরকারি কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথের মত তাদের হ্যাঁতে হ্যাঁ মিলিয়েছে।

অধিরাজ সরকার দশ মিটার দুরের পুলিশ ভ্যান থেকে গোটা পুলিশ বাহিনীকে পরিচালনা করছিলেন। ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ বাহিনী ততক্ষণে একটু পিছিয়ে জায়গা করে দিয়েছে সাদা পোষাকের পুলিশকে। শুরু হয়ে গেছে বেধরক লাথি, ঘুঁষি, মার। তৃণাকে টানতে টানতে একটা ষণ্ডা মত লোক ভ্যানের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অত্রি অধিরাজের দিকে তাকিয়ে দেখল তিনি, ওয়াকিটকিতে কি সব বলছেন। তার পাশে দাঁড়ানো অন্যান্য অফিসাররাও নির্বিকার।


স্বধর্ম্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে ||

স্বধর্ম্ম প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া ভীত হইও না। ধর্ম্ম্য যুদ্ধের অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয় আর নাই।

অত্রি হঠাৎ অনুভব করল ওর পা চলতে শুরু করেছে। তুহিনের নাক ফেটে রক্ত পড়ছিল। অত্রি এক লাফে তুহিনের শরীরের ওপর নিজেকে ফেলে দিল। সামনের দিক থেকে যেই আসুকনা কেন তুহিনের শরীরে আর একটা আঘাতও অত্রি লাগতে দেবে না। চক্ষের পলকে অত্রির পিঠে, ঘাড়ে খেপা কুত্তার মত ঝাঁপিয়ে পড়ল ঠেঙারে বাহিনী। অসহ্য ব্যাথায় ওর সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল।

তেলেঙ্গানার পুলিশ মাত্র দু সপ্তাহ আগে মাওবাদী পার্টির শ্রুথি কে গ্রেফতার করে তার সমস্ত শরীর ছিন্নভিন্ন করেছে। অত্রি, শ্রুথির মৃতদেহের ছবি দেখেছে। হাত কনুই থেকে নব্বই ডিগ্রী ঘোরানো। পাকস্থলী এসিডে পুড়ে গেছে। সমস্ত শরীরে ক্ষতচিহ্ন। সন্তানহারা পিতার মত কান্নায় ভেঙে পড়েছেন কবি ভারভারা রাও। বিজ্ঞানের ছাত্রী শ্রুথি নাকি অস্ত্র হাতে নিয়েছিল এই দেশটাকে বদলানোর জন্য। আদিবাসী থেকে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য সাম্যের খোঁজ করতে সে দাঁড়িয়েছিল টাটা বিড়লার অঙ্গুলিহেলনে চলা এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে।

অসহ্য ব্যাথায় শরীর অবশ হওয়ার মুহুর্তে অত্রি কেমন করে না জানি শ্রুথির কথা ভাবছিল। অসম্ভব ভাবনা। নিজের ব্যাথা ভিন্ন অন্য কিছু ওর মগজে আসতে পারে এই মুহুর্তটায়, তা অত্রি ভাবতেও পারেনি।

ও আঁতি পাঁতি করে ভাবছিল, কতটা লেগেছিল শ্রুথির ? কতটা ব্যাথা পেয়েছিল ওর সমবয়সী এই মেয়েটি?

‘মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।
আগমাপায়িনোহ নিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত

হে কৌন্তেয়! ইন্দ্রিয়গণ ও ইন্দ্রিয়ের বিষয়ে তৎসংযোগ, ইহাই শীতোষ্ণাদি সুখদুঃখজনক। সে সকলের উৎপত্তি ও অপায় আছে, অতএব তাহা অনিত্য, অতএব হে ভারত! সে সকল সহ্য কর’

অত্রিরা এখনো আছে। অত্রিরা দলে বাড়ছে।

কোন শহরতলীতে শ্রমজীবির জন্য হাসপাতাল গড়ছেন বিকাশ রায়। যুদ্ধ হবে।

কোন গ্রামে, বিদেশী কোম্পানির বীজকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দেশীয় বীজে চাষ করছেন শুভ্র সামন্ত। যুদ্ধ হবে।

কলকাতার কোন পাড়ায় থার্ড থিয়েটারের দল খুলেছেন বিনায়ক। যুদ্ধ হবে।

হরিয়ানার শ্রমিক বস্তিতে পড়ে আছেন সুমিত আর বিজন। দক্ষিণের চা বাগানে শ্রমিক ঐক্যের ঝাণ্ডা তুলছেন সুধাকররা। উত্তর বঙ্গের চা বাগানে ক্যামেরা ধরেছেন সত্রাজিৎ। পুর্ণেন্দু বিজ্ঞান নিয়ে লিখছেন সুদূর ইউরোপ থেকে। যুদ্ধ হবে।

যুদ্ধ হবে সমস্ত ফ্রণ্টে। আঁকায়, লেখায়, রেখায়, বিজ্ঞানে, সঙ্গীতে, কারখানায়, মাঠে, ময়দানে।

আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে যে ক্রিতদাস প্রথম মাথা তুলেছিল ফারাওএর বিরুদ্ধে সে এক অলীক স্বপ্ন দেখেছিল প্রকাশ্য দিবালোকে। দাসত্ত্বহীন সমাজব্যাবস্থার স্বপ্ন। কতটা অসম্ভব ছিল তার স্বপ্ন?

আজ অত্রিরা স্বপ্ন দেখছে এক শ্রেণিহীন, শোষণমুক্ত সমাজের। কতটা অসম্ভব তাদের সাধ? কে বাজি ধরবে?

Leave a Comment

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.