ফতুয়া, দ্য গ্লোবট্রটার (অচিন দেশে – ৩)

আসছে হপ্তায় কেনিলওয়ার্থে রীতিমত ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। শনিবার রাত্তিরে সাড়ে বত্রিশভাজা জনগণ আমার ঘরে জড়ো হবে। রান্না বান্নার প্ল্যান করেছি রীতিমত। চিংড়ির চপ আর মাশরুম ওমলেট দিয়ে শুভ মহরত করে, পাঁঠার ‘সহজ বঙ্গ সংস্করণ’ অবধি যাওয়ার ভোজসূয় ফন্দি।


‘বাঙালির চোখে জল এসে যায়’ এইসা সরিষার তেল জোগাড় হয়েছে গত সপ্তাহে। প্রায় দশ মাইল উজিয়ে একখান ভারতীয় মুদিখানা আছে। ‘ইন্দো-পাক মুদিখানা’। মার্কিণ দেশে ভারত পাকিস্তানের এই খাদ্য প্রণয় প্রায়ই দেখা যায়।
দোকানের মালিকের পদবী প্যাটেল। অথচ নামটি পারস্য দেশের। আমার ধারণা ছিলনা যে পাকিস্তানের বহু মুসলিম পরিবারে প্যাটেল পদবী দিব্যি চলে। হয়ত বা ভারতেও।
এই দোকানটা থেকেই পাঁঠা কিনেছিলাম গতবার। নাঃ, বউবাজারের হাজি সাহেবের পাঁঠার সাথে কোনও তুলনা চলবেনা। ‘বাঙালির পাঁঠা’ তো দুর অস্ত। সে আর কি করা যাবে। পাঁঠা ইস পাঁঠা। গত হপ্তায় রান্না করেছিলাম হাফ কেজি মত। সর্ষের তেল সহযোগে স্বাদটা মন্দ ওঠেনি।
আফ্রিকার সিয়েরা লিয়োন থেকে আহমেদ এসেছে পড়তে। আহমেদের মাতৃভাষা ‘ফুলানি’। আমি থাকি পাঁচ তলায়। আহমেদ চারে।
আমিঃ ‘তোমাদের প্রধান খাদ্য কি?’
আহমেদঃ ‘ভাত। তার সাথে কিছুটা তরকারি, আর মাংসের ঝোল থাকে।’
আমিঃ ‘বাহঃ এতো আমার দেশের মত।’
আহমেদের দেশেও হাত দিয়ে ভাত খাওয়ার চল। চামচ পারতপক্ষে কেউ ব্যবহার করে না। খাওয়ার আগে সবাই একটা যায়গায় হাত ধুয়ে নেয়।
‘আমার দেশে একা একা কেউ খায় না। পরিবারের সবাই একসাথে বসে খায়।’ আহমেদ বাসে যেতে যেতে বলছিল। আসছে হপ্তার ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে অতএব আহমেদের জন্য চওড়া নিমন্ত্রণ।
আমিও পারতপক্ষে একা খেতে ভালবাসি না। মাঝে সাঝেই লোক জুটিয়ে আনি। চীন দেশের লু, গ্যাভিন, শেঙদের নেমন্তন্য করি। পাশের পাড়ার বঙ্গসন্তানদের ডেকে ডুকে নিয়ে আসি। মহারাষ্ট্রের কিছু ছেলে মেয়ে আছে তিন তলায়। তারাও আসে। আমাদের ফ্ল্যাট গুলোয় রান্নাঘরটা বেশ ভাল। ওভেন, গ্রিল, হটপ্লেট, ফ্রিজ জাতীয় উপকরণ মজুত। আসার আগে অল্প দার্জ্জিলিং চা নিয়ে এসেছিলাম। সন্ধ্যে গুলোয় মাঝে সাঝে চায়ের আড্ডা বসে।
উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টের বাসিন্দা কিলিয়ান থাকে। আর থাকে আমাদের কলিকাতার দীপ। একদিন সন্ধ্যেবেলা দীপ উত্তেজিত ভাবে আমায় বলল ‘পিক এন্ড সেভ’ দোকানে নাকি পনেরো ডলারে তিরিশটা বিয়ার পাওয়া যাচ্ছে! কিলিয়ানের আবিষ্কার!
জার্মানরা সস্তার মদ খুঁজে পাবে এ বলাই বাহুল্য। এ অনেকটা বাঙালির পাঁঠা আবিষ্কারের মত। যেখানেই যাই না কেন, হতেই হবে।
আমার মদে খুব আগ্রহ নেই। কিন্তু হুজুগে আগ্রহ বিস্তর। দীপের সাথে বিয়ার খুঁজে পেতে নিয়ে এলাম পেটি ভরে।
কেনিলওয়ার্থ হল আমার ফ্ল্যাটবাড়ির নাম। সাততলা এপার্টমেন্ট। ভেতরে পার্কিং এর ব্যবস্থা, জিম, কনফারেন্স রুম, লন্ড্রি রুম ইত্যাদি আছে। এছাড়া ওয়াইফাই এর বন্দোবস্তও বেশ ভাল। আমার ফ্ল্যাটে আমি একটা ঘরে থাকি আর দক্ষিণ কোরিয়ার এক তরুণ পাশের ঘরে থাকে। দুটো বেডরুম ছাড়া, রান্নাঘর, বাথরুম আর ডাইনিং স্পেস। রান্নাঘরে কেনিলওয়ার্থ কর্তৃপক্ষই ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, হটপ্লেট আর গ্রিলের ব্যবস্থা করে রেখেছে। বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ঘরভাড়া আর রান্নাঘরের জিনিষপত্রের ভাড়া সমেত মাসে ছ’শো ষাট ডলার খরচ (যেটা আমার স্কলারশিপ থেকে আসে)। একটু কষ্টে সৃষ্টে থাকলে, বাইরে ঘর ভাড়া নিলে, সমস্তটা চারশো ডলারেও নেমে আসতে পারে।
খরচের ফিরিস্তিটা দেওয়ার একটা উদ্দেশ্য আছে। ক্রয়ক্ষমতার হিসেবে এক ডলার হল সাতটাকা। (অর্থাৎ এক ডলারে মার্কিণ দেশে যা কেনা যায়, ভারতে তার দাম সাতটাকা। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, এখানে এক পাউণ্ড পাঁউরুটির দাম ২ ডলারের কিছু কম। একই পাঁউরুটি ভারতে পাওয়া যাবে ১৪ টাকায়। অবশ্য সমস্ত পণ্যের ক্ষেত্রে এটা সত্যি নয়। কিন্তু একটা গড় ধরলে এক ডলার সমান সাত ভারতীয় টাকা হয়)।
সেদিক থেকে ছ’শো ষাট ডলার সমান হাজার পাঁচেকটাকা হচ্ছে। (পাঁচ হাজার টাকার পাঁউরুটি ভারত থেকে কিনে আমেরিকায় এসে বেচলে, ছশো ষাট ডলার পাওয়া যাবে। অবশ্যই এর মধ্যে জাহাজ খরচা বা ট্যাক্স ধরা নেই)। এই হিসেবে, আমেরিকা বেশ সস্তা জায়গা। পাঁচহাজার টাকায় অন্তত কলকাতায় একটা গোটা ঘর, ফ্রিজ, মাইক্রওয়েভ, গ্রিল, আনলিমিটেড দ্রুত ইন্টারনেট, কেবল কানেকশন, জিমন্যাশিয়াম আর সমস্ত ঘরের এয়ারকন্ডিশনিং পাওয়া যাবে না। মাথায় রাখতে হবে যে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট আর কেবলের জন্য আলাদা করে কোনো পয়সা দিতে হচ্ছে না। সবই ছ’শো ষাট ডলার মধ্যে ধরা আছে।
আরেক ভাবেও হিসেবটা করা যায়। দিল্লী বা হায়দ্রাবাদে, অন্তত আমি যতটুকু শুনেছি, ত্রিশ হাজারটাকা মাস মাইনের কর্মচারী, পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা খরচ করে ঘরভাড়ার পেছনে। বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, কেবল কানেকশন আর জিমন্যাশিয়ামের খরচা ধরলে, খরচটা অবশ্যই পনেরো হাজারটাকার কম নয়। সেদিক থেকে দেখলে, রোজাগারের প্রায় অর্ধেক বেরিয়ে যাচ্ছে এর পেছনে। তুলনায় আমাদের মাসিক রোজগারের হয়ত তিনভাগের একভাগ খরচ হচ্ছে কেনিলওয়ার্থে।
রোজগার আর খরচের অনুপাত সত্যিই ভাবার মত। এক শ্রেণির মানুষের কাছে, এক অর্থে আমেরিকা ভারতের তুলনায় সস্তা জায়গা।
সস্তা হোক বা দামি, আমাদের হাতিবাগানের করিমচাচার জবাব নেই। ফতুয়া এনেছিলাম খান দুই। একশো ষাট টাকার থেকে দরদাম শুরু। এখানে আসার পর প্রথম সপ্তাহে একটু প্যান্ট শার্ট পরে কায়দাবাজি করতে গেছিলাম। তারপর দেখলাম, এত পরিশ্রম পোষাচ্ছে না। ব্যাক টু ফতুয়া। সে ঘরেই হোক বা ক্লাসরুমে।
আগামী শনিবার আহমেদ হাপুস হুপুস করে হাত দিয়ে ভাত মেখে খাবে কিনা, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের নাম করে ‘কোমল গান্ধার’ দেখালে অতিরিক্ত আঁতলামি হবে কিনা (বা ঋত্বিক ঘটকের কাজ প্রথমবার দেখে চীনা বন্ধুরা আবার দেখতে চাইবে কিনা), অথবা ফেস্টিভ্যালের মাঝামাঝি স্বয়ং জটায়ুকে থ করে দিয়ে কিলিয়ান আরো সস্তার মদ খুঁজে আনবে কিনা, এ সমস্তই সম্ভাবনার খেলা। নিশ্চিত শুধু আমার করিমচাচার থেকে কেনা ফতুয়ার সাহচর্য্য। কাঁধে গামছা ফেলে রান্না করার ফাঁকে, হঠাৎ পোষাক ছুঁয়ে দেখলেই বাংলাদেশ!

Leave a Comment

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.