চেনা আলো অচেনা অন্ধকার (অচিন দেশে ২)

(এর আগে ‘অচিন দেশে ১‘ এ লিখেছি “শুধু কখনো কখনো নিয়ম গুলো ভেঙে যায়। আর সেই হচ্ছে চুড়ান্ত এডভেঞ্চারের সময়।”)

সকালবেলায় মাঝে মাঝেই চলে যেতাম বাগবাজার ঘাটে।

তখন সবে আলো ফুটছে। পুজারিরা সূর্য্যপ্রণাম করে ভিজা শরীর মুছে নিচ্ছেন লাল চেক চেক গামছায়। বয়স্ক মারোয়ারি ভদ্রলোক তার আদ্যিকালের নোকিয়া ফোনে মুকেশের গান চালালেন। ঈষৎ ভারি চেহারার সহধর্মিণী প্রাণায়ামে বসে পড়েছেন ঘাটের ধারে। হয়ত ডায়বিটেস আছে। লিটিল স্ট্র‍্য্যাণ্ড রোডের ধারে চক্ররেল। তারই ধার দিয়ে হাজারো ঝুপড়ি। সেখানেও তখন সকাল আড়মোরা ভাঙছে। মাটির উনুনে আগুন দেওয়ার জোগাড় চলছে।

সাড়ে ছটা নাগাদ হাঁটা দিলাম মানিকতলার দিকে।

কি ভালো মাছ উঠেছে আজ! খাস পদ্মার রুপোলি ইলিশ। ‘কত্তা!এ এক্কেবারে রানি মাছ। এই তো পেটের কাছটা দেখেন’।

গোল মুখের ইলিশ। পেটের কাছটায় রুপো রঙের ছিটা। একটু টিপে দেখতে দেখতে বললাম,’কতয় দেবে? ডিম হবে না তো? দেখো বাপু। পদ্মা বলে রুপনারায়ণ গছালেই চিত্তির’।মাছওয়ালা ‘শেষ দাম’ হাঁকার পরেও মিনিট দশেকের তরজা চলে। বাঁদিকে বড় বড় টিনের বারকোশে ততক্ষণে কই লাফাচ্ছে। কাকে ছেড়ে কাকে ধরি অবস্থা।

বাজার থেকে বাড়ি। সেখানে থেকে অল্টো নিয়ে হেদুয়া। ‘আচ্ছা তুই জোড়াসাঁকো থেকে বাগবাজার হয়ে মানিকতলা গেলি হেঁটে। আর দুপা দুরে হেদুয়া যাস গাড়ি নিয়ে। ফান্ডাটা কি?’ কেমন করে বোঝাই যে সকালবেলা বাহনটাকে একটু হাওয়া না খাওয়ালে মন উচাটন হয়।

সোয়া সাতটায় সাঁতার। গতকাল মোহনবাগান তিন গোল খেয়েছে বারাসত স্টেডিয়ামে। তেল মাখতে মাখতে ব্যারেটোর চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার হয়ে গেল।

এরপর দিনটা কতদিকে এগোতে পারে ভাবা যাচ্ছে না। শিয়ালদা বা হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে চুর্ণি নদি বা চন্দননগর যেতেই পারি। চন্দননগর স্ট্র‍্যাণ্ডে দই ফুচকা অথবা কল্যাণীর আপ্যায়নের মুরগীর ঝোল। দুপুরের খাওয়া নিয়ে নো টেনশন।

বিবেকানন্দ লাইব্রেরিতে দুপুরটা পড়াও যায়। লাঞ্চে নবীন ময়ড়ার মেঠাই হয়ে যাক। অথবা গোলবাড়ির কষা। তবে যাই করি না কেন, দুপুর একটা নাগাদ, ফোন ঠিকই আসবে, “বাবু, খেতে আসবে না?”

রেগে গেলে, মা তুমি করে বলে। আর মায়ের পঁচানব্বই ভাগ ফোন হয় খাওয়া সংক্রান্ত। হয়ত ফোনে মা’কে বল্লাম, “এই তো নোবেল প্রাইজ নিচ্ছি” অথবা জানালাম, “পুলিশের কাছে কেস খাচ্ছি, হয়ত থানায় যেতে হবে”, মায়ের প্রাথমিক রিয়্যাকশন সবসময়েই হয়, “দুপুরে খাসনি কিছু, আর বাইরে খাস না। বাড়ি আয়।”

বোঝো ঠেলা।

বিকেলগুলো বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি। ‘তুই কোথায়?’ কন্ঠস্বরে শুনলেই বোঝা যায় যে জার্মান ফিফথ প্যান্থার বাহিনী ভোলগা নদী পেরিয়ে গেছে। অনতিদূরেই স্তালিনগ্রাদ। রুশ জার্মানের মরণপণ লড়াই আসন্ন।

‘এই তো কলেজস্ট্রিট ক্রসিং।’

‘আমিও কলেজস্ট্রিট ক্রসিং। সত্যি করে বল কোথায় আছিস। দয়ায়ায়া করেএএএ সত্যিটা বল।’

স্তালিনগ্রাদ আক্রান্ত। মরীয়া লালফৌজ। শেষ চেষ্টা করতেই হবে। দৌড় লাগালাম। বাঁদিকে গ্রেস সিনেমা, ডানদিকে ডাকব্যাকের দোকান গুলো পেরিয়ে কলেজস্ট্রিটের মোড়টা দেখাই যাচ্ছে।  মোড় ঘুরতেই, বটকৃষ্ণ দত্তের মুর্তির সামনে, লাল কুর্তি পরণে, শ্রীমতি দাঁড়িয়ে। মুখ চোখ দিয়ে রাগের হলকা বেরুচ্ছে। কিন্তু চোখাচুখি হতেই, …

সে সব হাসি তো তোমরা দেখোইনি।

সন্ধ্যে নামছে। এই তো কৌশিক, অনিন্দিতা অফিস থেকে ফিরবে। জয়ন্ত ফিরবে রিহার্সাল থেকে। আমার পড়ানো আছে রাত্তিরে। তাই একটু তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। কলেজ স্ট্রিটের ফেভারিট কেবিনে সন্ধ্যের আড্ডা পুরো জমে ক্ষির। রাজনীতি থেকে সাহিত্য, গান থেকে বিজ্ঞান, অর্থহীন বাজে বকা থেকে হঠাৎ করে ক্ষেপে ওঠা। কঙ্কদা চেয়ার মুছতে আসার মিনিট দশেক পরপরই হয়ত পরিতোষদাও ঢুকবে বইএর ঝোলা নিয়ে। অনেকদিন পর সৌম্য ঢুকবে লিফলেটের গোছা হাতে, অথবা জুলদা বলবে নতুন সিনেমার গপ্পো।

সন্ধ্যেটা কিন্তু একাডেমিতেও থাকতে পারতাম। ব্রাত্যজনের বিচ্ছিরি নাটক দেখে অথবা মিস্টার কাকাতুয়ার ফ্যান্টাসটিক অভিনয় চেখে, সন্ধ্যের মজলিস জমে যেত। নাটকের ঠিক মাঝামাঝি বিরতি। জলদি বেরোতে হবে। নইলে ডিমের চপ আর কফি শেষ হয়ে যাবে। দোতলায় ওঠার গেটের সামনের সিঁড়িতে বসে ফিসফ্রাইতে হালকা কামড় দিতে দিতে ওর দিকে লুব্ধ হয়ে তাকাবো। একটু কি ভুরু কুঁচকালো? ‘এইনে’, ওর ভাগের একটু ফিশফ্রাইও জুটে যাবে কপালে।

রাত্তিরে মহড়া আছে। পুজো আর একশো দিন বাকি। এবার নাকি পাড়ায় মুর্তি বানানো হবে। নাটক আর গানের মহড়া শুরু হবে আগামী সপ্তাহে। রাত্তিরে অভিযানও আছে। আমার বড় গাড়িটা ঘরে ফিরছে অনেকদিনের পর। যাবে নাকি মাইথন বা উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে? আরে বেশি দুর নয়। মাত্র চারশো কি সাতশো কিলোমিটার। এই যাবো আর আসব।

2 Comments

  1. debarati datta gupta says:

    agei bolechhi lekhak hoyei na phire aso tumi, eto bhalo likhchho ! kolkata tomar moddhye erakomi sajib r satej hoye bachuk.

    Like

Leave a Comment

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.