রাস্তার ধার দিয়ে একঝাঁক নারী পুরুষ হেঁটে যাচ্ছে। কেউ বা একটু দৌড়াচ্ছে। ঢিমে তালে। কিন্তু দৌড়াচ্ছে। প্রত্যেকের কাঁধে বেত দিয়ে তৈরী বাঁক। বাঁকের দুই আগায় দুটো কলসী।
এই জায়গাটার নাম ‘নিশ্চিন্তপুর’। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার গঞ্জ। সুন্দরবনের সীমানায়। লোকগুলো যাবে তারকেশ্বর। এখান থেকে প্রায় সত্তর কিলোমিটার। কিছুটা হেঁটে, কিছুটা দৌড়ে। যে যেভাবে পারে।
শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার। সকাল থেকেই গোছা গোছা মেঘ আকাশ ঢেকে দিয়েছে। থেকে থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো টিপ টিপ করে। কখনো মুষলধারে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এই সব জায়গা আজ থেকে বছর চল্লিশ আগেও ঘন জঙ্গল ছিল। এখন জঙ্গল কেটে গ্রাম, গ্রাম কেটে শহর হয়েছে। মাটির পায়ে চলা পথ ইঁটে ঢেকেছে। ইঁট চাপা পড়েছে পিচ ঢাকা রাস্তায়। একশো সতেরো নম্বর জাতীয় সড়কের দুধারে মানুষ তার পৃথিবীকে যেমন পারে, যতটা পারে, কেটে কুটে গুছিয়ে নিয়েছে।
কিন্তু এত করেও সুন্দরবনের আদিম ভাবটা একে বারে মুছে ফেলা যায়নি। যেখানে যেখানে বসতি একটু কম, বাইন আর গরাণ গাছ জায়গা দখল করেছে। একদিকে শ্রাবণ শেষের তুমুল বৃষ্টি। অন্যদিকে বাইন গাছের পঞ্চাশ ফুটের কাছাকাছি দেহের পাগল করা নাচ। এরই মধ্যে দিয়ে লোকগুলো ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। সন্ধ্যের আগে তারা পৌঁছে যাবেই তারকেশ্বর। তারকেশ্বর পোঁছে তারা শিবলিঙ্গে পুজো দেবে। সন্তানহীনার সন্তান হবে, বেকার যুবকের চাকরি হবে, বৃদ্ধ বাপের কোর্ট কেসে জয় হবে। এটুকু শিব তাদের জন্য করবেনই। অন্তত এই তাদের বিশ্বাস।
কাতার দেশের রাজধানী দোহা। আজ সকাল সাড়ে ছটায় পৌঁছেছি। একটা ছোট্ট এয়ারবাস আমায় কলকাতা থেকে দোহা নিয়ে এসেছে। ভোর চারটের উড়ান ছিল। তার আগের কুড়ি ঘণ্টা কেটেছে তীব্র ব্যস্ততায়। আমার গোছগাছ সব সময়েই শেষ মুহুর্তের জন্য তোলা থাকে।
ভোর চারটের সময় ঘুম চোখে বিমানে উঠেছি। উঠেই ঘুমিয়ে পড়েছি।
দোহা আজ থেকে অর্ধ শতক আগেও মাছুয়াড়দের আড্ডা ছিল। পয়সাওয়ালাদের হিসেবে, সে ছিল নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় একটা জায়গা। তারপর একদিন যেন জাদুকরের ছোঁওয়ায় সব পালটে গেল। মধ্যপ্রাচ্যের আর পাঁচটা দেশের মতই তেল বেচার টাকায়, কাতার দেশও নিজের ভাগ্য ঘুরিয়ে দিয়েছে। অন্তত বাইরে থেকে দেখলে তাই মনে হয়। ইউরোপ, আমেরিকার ধনিকশ্রেণীর চোখে রাতারাতি কাতার এক উল্লেখযোগ্য গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
এর আগে একবার দুবাই বিমানবন্দরে এসেছি। দোহাও প্রায় একই রকম। আলো ঝলমলে। বিরাট। এলাহি সব দেশো বিদেশের খাদ্য ও পানীয়ের সম্ভার। ইউরোপিয় ও মার্কিণদেশের পণ্যদ্রব্যে উপছে পড়ছে হাজারো বিপণি। মোটের ওপর একটা ক্ষুদ্র শহরই বলা চলে। টিকিট কাটার দোষে আমায় এখানে উনিশ ঘন্টা কাটাতে হবে। এরপরের গন্তব্য প্যারিস।
বিমানবন্দরে ইন্টারনেট বিনামুল্যে পাওয়া যায়। এছাড়া খাওয়া, শোওয়ার জায়গাও আছে। অতএব এই উনিশ ঘণ্টার অপেক্ষা নিয়ে আমার খুব মাথা ব্যাথা নেই।
আমি যেখানে বসে আছি তার ঠিক উল্টো দিকে একটা মধ্যপ্রাচ্যের পোষাকের দোকান। দোকানের নাম বেশ জাঁকালো। আলমোতাহাজিবা। পশরার মধ্যে আছে নানা রকমের বোরখা আর ও দেশের মেয়েদের পোষাক। একজন মহিলা ঘুরে ঘুরে বোরখা গুলো দেখছেন। হয়ত কিনবেন। হঠাৎ হেনরী ফোর্ডের সেই উক্তি মনে পড়ে গেল, “customer can have a car painted any colour that he wants so long as it is black.”
খানিক বাদে একজন মাঝারি চেহারার পুরুষ দোকানে ঢুকলেন। বেশ লম্বা দাড়ি। পড়নে একটা লম্বা সাদা কাপড়। কাপড়টা উত্তরীয়র মত করে সমস্ত দেহে জড়ানো। ধোপদুরস্ত এই বিমানবন্দরে তার এই পোষাক বেশ বেমানান। হয়ত এই বিচিত্র বেশ কোনও শোক অথবা ধর্মীয় উৎসবের চিহ্ন।
যে মহিলা বোরখা দেখছিলেন, তিনি পুরুষটির দিকেই এগিয়ে গেলেন। ততক্ষণে ভদ্রলোক হাতে একটা বোরখা তুলে নিয়েছেন। এই তো তিনি একটু হেসে বোরখাটা এগিয়ে দিলেন মহিলার দিকে। তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত আর মুখের হাসি দেখে বেশ বোঝা যায় যে পরের মুহুর্তেই মহিলা এই বোরখাটা নিয়ে নেবেন। বেশ বোঝা যায় যে মহিলার চোখে মুখেও ছড়িয়ে পড়বে হাসি। তারপর হয়ত তিনি বাড়ি ফিরবেন। কৃষ্ণবর্ণের বোরখাটা পরম আদরে পড়ে নিজেকে দেখবেন আয়নায়। মুখ ঢাকবে, হাত ঢাকবে, ত্বকের সমস্ত চিহ্ন নিভে যাবে। আর এসবই তিনি করবেন নিতান্ত আনন্দের সাথে। পুরুষটি হয়ত এই ভেবেই একটুখানি হেসে বাড়িয়ে দিয়েছেন বোরখাটা। অন্তত তার বিশ্বাস আছে যে এমনটাই ঘটবে।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নিশ্চিন্তপুর হোক বা কাতার দেশের রাজধানী দোহা, গরাণ আর বাইন গাছে ঘেরা জাতীয় সড়ক হোক বা ঝলমলে দোকানে ঘেরা বিমানবন্দর, অভ্যাস আর বিশ্বাসের খাতিরে আমরা কত কিছুই না করি। যা বিশ্বাস, যেমনটা নিয়ম, তেমনটাই ঘটবে এটাই আমরা মেনে নিই। এটাই আমরা জানি। শিব আমাদের দুঃখ ঘোচাবেন, মেয়েরা পুরুষদের বাড়িয়ে দেওয়া বোরখা দিব্যি পড়ে নেবে, এসবই অভ্যাস। অভ্যাস যা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে।
শুধু কখনো কখনো নিয়ম গুলো ভেঙে যায়। আর সেই হচ্ছে চুড়ান্ত এডভেঞ্চারের সময়।
মার্কিণ দেশে যাচ্ছি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করতে। হয়ত বছর পাঁচেক থাকতেও হবে। যা দেখছি, যা ভাবছি, সে সব নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা। ‘অচিন দেশে’র লেখা জোখা নিয়েই এই সংকলন। পড়ে কেমন লাগছে জানালে ভালো লাগবে।
(ক্রমশঃ) – এর পর ‘অচিন দেশে ২‘
বাকি কাথার অপেক্ষা রইল……
LikeLike
তুই পড়ছিস জেনে ভালো লাগছে
LikeLike
তর্কে সিদ্ধান্ত করি তবু খাদ্য আহার-ই
বিশ্বাসে মেলায় বোরখা ধর্মে বাহারী …
LikeLike
porte jachho ganit, kintu tomar lekha pore asha jagchhe oitihasik ba sahityik hoeyo phirte paro. notun lekhar apekshay roilam.
LikeLike
কি জানি কি আছে কপালে। তবে পড়ছেন জেনে ভালো লাগছে।
LikeLike
তোমার কবিতা শুনতে ফোন করব একদিন
LikeLike