কলকাতা ২ ১/২ (উত্তরাধিকার) 

(এর আগে ‘কলকাতা ১‘ এ লিখেছি “কলকাতায় থেকে অর্থ এবং বিদ্যা উপার্জন করা সহজেই সম্ভব। আর ব্যস্ততার ভনিতা ছাড়া হয়ত কিছু ভাল কাজও সম্ভব।”
কলকাতা ২‘ এ লিখেছি “কলকাতায় এসো। তোমার বন্ধু, আপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই তোমায় জানলা দিয়ে ডাকতে আসবে, ‘কি রে… কি করছিস।’” )
কলকাতার থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার উত্তরে, হুগলি জেলায় ‘ত্রিবেণী’ নামে এক প্রাচীন জনপদ আছে । ত্রিবেণীর নাম ‘ত্রি’বেণী হল কেন? আজ থেকে সহস্রাধিক বছর আগে গঙ্গার মুল স্রোত ভাগিরথী দিয়ে বইত। পদ্মা তখন ভাগিরথীর ক্ষিণতনু ভগিনী মাত্র। হুগলীর ত্রিবেণীতে এসে ভাগিরথী তিনটি ধারায় ভেঙে গেল। পশ্চিমে সরস্বতী, মধ্যমে হুগলি আর পুবে যমুনা। (প্রসঙ্গত ‘সরস্বতী’ আর ‘যমুনা’ নামের নদী উত্তর ভারতেও আছে)। যেখানে এক নদী হয়ে যায় তিন, তারই নাম ‘ত্রি’বেণী।


মৌর্য্য যুগে পশ্চিমের সরস্বতী নদীই ছিল ভাগিরথীর প্রধান ধারা। মেদিনীপুর জেলার তমলুকের কাছে এসে সরস্বতীর সাগরসঙ্গম। সেদিনের সেই সরস্বতী নদী হল পুর্বভারতের প্রধান বাণিজ্য পথ। বাংলা, বিহার, আসাম, উত্তর প্রদেশের বণিকরা গঙ্গা দিয়ে পণ্য বোঝাই নৌকা পাঠাতেন। ত্রিবেণী থেকে পণ্যতরী পশ্চিমে বেঁকে সরস্বতীর স্রোত বেয়ে সাগরের দিকে এগিয়ে যেত।

মেদিনীপুরের তমলুকে সরস্বতীর মোহানা। এইখানেই সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন বন্দর তাম্রলিপ্ত। বন্দর থেকে শ’য়ে শ’য়ে জাহাজ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ত। বাংলার মসলিন আর গুড় সোনার দরে বিকাতো রোম, সুমাত্রা, চীনের বাজারে।

ধীরে ধীরে সরস্বতীর মুখে পলি জমার ফলে, তাম্রলিপ্ত বন্দরের নাব্যতা কমে গেল। খ্রিষ্টিয় সপ্তম শতাব্দী নাগাদ হুণ জাতির আক্রমণে রোম সাম্রাজ্য ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। চন্দ্রগুপ্ত এবং পরবর্তীকালে স্কন্দগুপ্তের পরাক্রমে হুণজাতি, ভারত ধ্বংস করতে পারল না। কিন্তু ভারতের বহির্বাণিজ্য লক্ষি আরব সাগরের জলে ডুবতে আরম্ভ করলেন। একদিকে রোমের বাজার অন্তর্হিত। অপর দিকে জলদস্যুর উৎপাত। গোদের ওপর বিষফোঁড়া যুদ্ধবিগ্রহের বিপুল ব্যয়। সরস্বতীর নাব্যতা যেন ভারতলক্ষীর সাথে হাত ধরা ধরি করে দেশত্যাগে উদ্যত হল। নদী ততদিনে সরতে শুরু করেছে পুবের দিকে।

প্রায় তিন শতাব্দী পরে, তাম্রলিপ্তের উত্তরসূরী হিসেবে উঠে এল সপ্তগ্রাম বন্দর। সেই সরস্বতীর তীরে। অবশ্য সরস্বতী ততদিনে আরও বেশ কিছুটা পুবে হঠে এসেছে। পাল রাজাদের রাজত্ত্ব থেকে শুরু করে মোগল জমানার শেষ দিন পর্য্যন্ত পশ্চিমে সপ্তগ্রাম আর পুবে চট্টগ্রাম ছিল বাংলার প্রধান বন্দর। পর্তুগীজদের ভাষায় ‘বড় স্বর্গ’ (চট্টগ্রাম) আর ‘ছোট স্বর্গ’ (সপ্তগ্রাম)। সপ্তগ্রামের সমৃদ্ধি ছিল প্রবাদপ্রতীম। ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে সপ্তগ্রামের পতনের শুরু। গঙ্গার জল ততদিনে ভাগিরথী ছেড়ে পদ্মার দিকে ছুটছে। সরস্বতী মজতে শুরু করেছে। নদী বন্দরের নাব্যতাই প্রাণ। যে কারণে তাম্রলিপ্তের পতন কতকটা সেই কারণেই সপ্তগ্রামের মৃত্যু। এবং কলকাতার বন্দর শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ।

নদিমাতৃক বঙ্গদেশ দিয়ে গঙ্গার সাগরযাত্রা। সমগ্র আর্যাবর্তের বহির্বাণিজ্যের অন্যতম তোরণ এই দেশ (আরেক তোরণ অবশ্যই গুজরাতের সুরাত বন্দর)। বাংলার মানুষের ব্যাবসা বাণিজ্যে তুখোড় হওয়াই স্বাভাবিক। এ ছাড়া জল হাওয়া অনুকুল। অতএব ফসল ফলানো সোজা। বহির্বাণিজ্যের কারণে বাইরের জগৎএর সাথে পরিচিতি। অতএব বিদ্যাচর্চার পথও সুগম। বৌদ্ধ শিক্ষায়তনগুলির যে প্রধান অর্হতদের কথা জানা যায় তার মধ্যে অন্তত দুইজন প্রবাদপ্রতিম চরিত্র বাঙালি। পাল রাজাদের সমসাময়িক, বিক্রমশীল বিহারের মহাধ্যক্ষ অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, এবং শশাঙ্কের সমসাময়িক, নালন্দা বিহারের মহাধ্যক্ষ শীলভদ্র। মোগল সাম্রাজ্যের শেষলগ্নে যখন পর্তুগীজ দস্যুর অত্যাচারে সমস্ত বাংলা ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে, সেই দুর্দিনেও নবদ্বীপ অঞ্চলে কিছু জ্ঞানচর্চা হত।

বাণিজ্য এবং জ্ঞানচর্চার স্বাভাবিক কেন্দ্র এই বাংলাদেশে, সরস্বতী নদীর পুবমুখে সরে যাওয়ার (এবং পরবর্তীকালে সম্পুর্ণ অদৃশ্য হওয়ার) ফলে একে একে তাম্রলিপ্ত এবং সপ্তগ্রাম বন্দরের পতন। এবং এর সরাসরী ফলশ্রুতি হিসেবে কলকাতা বন্দরের জন্ম। এক হিসেবে তাম্রলিপ্ত, সপ্তগ্রাম আর কলকাতা ঠিক আলাদা শহর নয়। নদী যেমন সরেছে, বন্দরও সরে এসেছে পুবে। একই শহর যেন বার বার আত্মপ্রকাশ করেছে বিভিন্ন সময়ে।

বৃটিশ শাসকের হাতে যখন বাংলা তথা ভারতের সমস্ত শিল্প একে একে ধ্বংস হচ্ছিল, তখন কলকাতার বেড়ে ওঠা। শুরুর দিন থেকেই এই শহর ঠিক বাঙালির শহর নয়। সহজেই অনুমান করা যায় যে তাম্রলিপ্ত অথবা সপ্তগ্রামেও বাঙালি ছাড়া আরও বহু জাতির আনাগোনা ছিল। যেকোনো বন্দর শহরে স্বাভাবিক কারণেই বহু জাতির সমাগম হয়। আর কলকাতার চলা শুরুই তো বৃটিশের হাত ধরে। এক অর্থে কলকাতা তাই জন্মসূত্রে কসমোপোলিটান আর উত্তরাধিকার সূত্রে বাণিজ্যকেন্দ্র।

(হয়ত দুই কি তিন হাজার বছর আগে, সরস্বতীর বদলে হুগলি ছিল গঙ্গার প্রধান প্রবাহ। সম্ভবত তখন কলকাতা অথবা তার অনতি দুরে ছিল এক বিশাল বন্দর। বারাসতের কাছে ‘চন্দ্রকেতুগড়’র ধ্বংসাবশেষ থেকে আমরা এমনটা অনুমান করতে পারি।)

এরপরে ‘কলকাতা ৩’ যদি পড়তে চান, তাহলে এইটুকু পটভুমিকার প্রয়োজন।

1 Comment

Leave a Comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.